ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫

গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) নব্য বিএনপি নেতা নাহিদুজ্জামান নিশাদে কোণঠাসা ত্যাগীরা

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৫, ১১:৫০ পিএম

ছাত্র-জনতার গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর গাইবান্ধার স্থানীয় রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে বগুড়া থেকে নাহিদুজ্জামান নিশাদ গাইবান্ধায় এসে জেলা বিএনপির সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার এই আকস্মিক উত্থানে গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনে ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। এই আসনে নিশাদ ছাড়া অন্য সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিত সাবেক ছাত্রদল নেতা ও ভাস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি কামরুজ্জামান সোহাগ, অ্যাডভোকেট নাজেমুল ইসলাম নয়ন, অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, ময়নুল ইসলাম শামীম ও ফারুক আলম সরকার।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নাহিদুজ্জামান নিশাদ স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করতে এবং দলকে গুছিয়ে তোলার নামে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হওয়া বিএনপির ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা বর্তমানে কোণঠাসা। দীর্ঘদিন ধরে যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন এবং নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের অনেকেই নিশাদের আকস্মিক আগমনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। 
তাদের অভিযোগ, নিশাদ দলে নতুন হলেও দ্রুত পদ পেয়েছেন এবং নিজের অবস্থান সুসংহত করার জন্য দলের পুরোনো ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবজ্ঞা করছেন। এতে দলের ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে এবং ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিজেদের উপেক্ষিত মনে করছেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং তৃণমূলের বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দলের তৃণমূলের অসন্তোষ নিরসন না হলে এবং ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হলে তা দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা বাড়াবে। এই অবস্থায়, জেলা বিএনপির নেতৃত্বকে অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ও সংহতি ফিরিয়ে আনতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
জানা যায়, নাহিদুজ্জামান নিশাদের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার সীমান্তবর্তী গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ী ইউনিয়নে। নিশাদের বেড়ে ওঠা এবং লেখাপড়া বগুড়ায়। তার চাচাতো ভগ্নিপতি মেজর রাসেল পিএসসি ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা। সেই সূত্রে তিনি পদ পেয়েছেন বলে জানা যায়, তবে অন্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৮ কোটি টাকার বিনিময়ে রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও আব্দুল খালেকের মাধ্যমে পদটি বাগিয়ে নিয়েছেন। 
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক পত্রে উল্লেখ করা হয়, দলীয় নির্দেশক্রমে নাহিদুজ্জামান নিশাদকে গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহসভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। 
নাহিদুজ্জামান নিশাদ, যিনি এর আগে বগুড়ার একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কীভাবে গাইবান্ধা জেলা বিএনপিতে সহসভাপতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হলেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। দলের একটি বড় অংশের নেতাকর্মী মনে করছেন, তার এই পদ প্রাপ্তির পেছনে অর্থবিত্ত এবং দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগই মূল ভূমিকা রেখেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাইবান্ধা জেলা বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, ‘নিশাদ সাহেবকে আমরা আগে গাইবান্ধার রাজনীতিতে দেখিনি। হঠাৎ করে তিনি এসে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ পেয়ে গেলেন, এটা আমাদের জন্য বিস্ময়কর। যারা দীর্ঘদিন দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মূল্যায়ন না করে একজন বহিরাগতকে এমন পদ দেওয়াটা দুঃখজনক। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার ছবি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
তবে, দলের অন্য একটি অংশ এই পদপ্রাপ্তিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, নিশাদ একজন সফল শিল্পপতি এবং তার আর্থিক সচ্ছলতা দলের কার্যক্রমে গতি আনবে। এ ছাড়া হাইকমান্ডের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গাইবান্ধা জেলা বিএনপির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে বলে তারা মনে করছেন। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা বলেন,  তিনি (নাহিদুজ্জামান নিশাদ) যোগ দেওয়ার পরই এক পক্ষকে কাছে নিয়ে টাকার খেলায় মেতে উঠেছেন। পদ-পদবি বাগিয়ে নিতে নিজের বলয়ের লোকদের কাছে নিয়ে প্রকাশ্য গ্রুপিং করছেন। নেতাকর্মীদের নিজের বলয়ে আনতে না পারলেই ত্যাগী নেতাদের বহিষ্কার, কারণ দর্শানোর নোটিশ, মামলা-হামলাসহ নানাভাবে তৃণমূলের  নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে জেলা পর্যন্ত তার থাবায় কেউ রেহাই পাচ্ছে না। অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতারা। নাহিদুজ্জামান নিশাদ যোগ দেওয়ার  পর থেকেই দুই উপজেলায় গ্রুপিং প্রকাশ রূপ নিয়েছে। সাঘাটা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির মধ্যে ধরেছে ফাটল। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের কাউন্সিলেকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে গ্রুপিং করানোর অভিযোগ করেছেন নেতাকর্মীরা।
বিএনপি থেকে সাময়িক অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাঘাটা উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব ও ঘুড়িদহ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ তুলিপ বলেন, ‘আমি গত ৩৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। আমি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই। কিন্তু তারপরও সদ্য নেতা হওয়া নাহিদুজ্জামান নিশাদের কথা না শোনায় আমাকে মিথ্যা অভিযোগে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘নিশাত আগে আওয়ামী লীগ করত, এমন অনেক ভিডিও রয়েছে। তার বাহিনীতে যোগ না দেওয়ায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে এবং কেন্দ্রকে ভুল বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ানো হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, তা জানানো হয়নি। আমি নিজেও জানি না, কী অভিযোগে অভিযুক্ত।’ 
জুমারবাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক আবু তাহের ম-ল বলেন, ৫ তারিখের পরে বিএনপিতে পদ পেয়েছে, এর আগে বিএনপি করেনি। সবসময় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করত। দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মূল্যায়ন করছে। 
তাহের ম-ল দাবি করেন, জাসদের গাইবান্ধা জেলা কমিটির সহসভাপতি ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুস্তম আলী আকন্দ বিএনপিতে যোগ না দিলে তাকে কৃষক দলের সদস্য করেছেন নিশাত। এমন অনেককে বিএনপিতে পুর্নবাসন করছে। এ বিষয়ে নাহিদুজ্জামান নিশাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া ৭৬ বছর বয়সে ২০২২ সালের ২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ফলে তার সংসদীয় আসন গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) ২৪ জুলাই শূন্য ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে উপনির্বাচনে তপশিল ঘোষণা করেন ইসি। নাহিদুজ্জামান নিশাদ উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ওই আসনে আপেল প্রতীক নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রে ভোট ডাকাতির অভিযোগে নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে স্থগিত উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়। ওই নির্বাচনে কর্মী-সমর্থক ও ভোটাররা মিথ্যা মামলা-হয়রানির কবলে পড়বেন এমন শঙ্কায় ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ।