রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডেস্কটপ কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সর্বনি¤œ দরদাতার বদলে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত দরে সরঞ্জাম ক্রয়ের প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) বা সাবেক সিপিটিইউ। বিষয়টি গোচরে আসলে, চুক্তি বাতিল করে সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছে সিপিটিইউ। তবে এরই মাঝে অর্থবছর শেষ হয়ে যাওয়ায় বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত গেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। এদিকে কার্যাদেশ পেয়েও নির্ধারিত সময়ে কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারেনি স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এসব কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কারিগরী ল্যাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কারিগরী সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য গত বছরের ২২ অক্টোবর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র (ইজিপি দরপত্র নং-১০৫৯৯৯৩) আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গ্রিন বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন, স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড, স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং ইনভেনশন আইটি লিমিটেড দরপত্র জমা দেয়। সর্বনি¤œ দর হিসেবে ওয়ালটন ১ কোটি ৪৬ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকায় কম্পিউটার সরবরাহের কথা জানায়। গ্রিন বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন ১ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকায়, স্মার্ট টেকনোলজিস ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকায়, স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ১ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯০০ টাকায় এবং ইনভেনশন আইটি ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় কম্পিউটার সরবরাহে দরপত্র জমা দেয়।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ এর ধারা ৪৮(২) অনুযায়ী, সর্বনিম্ন দরপত্র দাখিলকৃত প্রতিষ্ঠান দরপত্রের কার্যাদেশ পেয়ে থাকে। তবে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। সর্বনিম্ন দরদাতা ওয়ালটনের থেকে স্টারটেকের দর ৩৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকা বেশি। দরপত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করে অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে বেআইনিভাবে সর্বনি¤œ দরদাতাকে বাদ দিয়ে বেশি দামে কম্পিউটার ক্রয়ের চেষ্টা করেছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। একইসঙ্গে ক্রয়নীতি অনুযায়ী দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের সময় আবশ্যিকভাবে বহিঃসদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সব সদস্য ছিলেন ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন বিভাগের প্রশিক্ষক বা শিক্ষক। তিন সদস্যবিশিষ্ট মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের উপধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান খান, চিফ ইনস্ট্রাকটর রেজাউর রহমান এবং মোশারফ হোসেন। উপরন্তু, দরপত্রে ‘নন-রেসপন্সিভ’ দেখানো হয় সর্বনি¤œ দরদাতা ওয়ালটনকে।
এ বিষয়ে গত ৪ জুন বিপিপিএ-তে লিখিত অভিযোগ করে ওয়ালটন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, দরপত্র মোতাবেক সব শর্ত পূরণ করে সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তাদের মূল্যায়নে কতিপয় খুবই ক্ষুদ্র ও অপ্রাসংগিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তার ওয়ালটনকে ‘নন-রেসপন্সিভ’ দরপত্রদাতা হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ দরপত্র আহ্বান এবং ক্রয় সম্পাদনে পিপিআর-২০০৮ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) এবং পিপিএ-২০০৬ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট) এর অনেক নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিপিপিএর রিভিউ প্যানেল অভিযোগ যাচাই করে ক্রয় প্রক্রিয়ায় নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ার প্রমাণ পান।
এতে দেখা যায়, উক্ত দরপত্রের মূল্যায়ন কমিটির পাশাপাশি দুই সদস্যবিশিষ্ট কারিগরি সাব-কমিটির সব সদস্যই ছিলেন আভ্যন্তরীণ। তারা ছিলেন ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের চিফ ইন্সট্রাকটর আয়েশা সিদ্দিকা এবং নিগার সুলতানা। বিপিপিএ-এর রিভিউ প্যানেল অভিযোগকারীর আপিল মঞ্জুর করে সিদ্ধান্ত দেয়। ৯ পাতার এই সিদ্ধান্তের কপি এসেছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে।
রিভিউ প্যানেল ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষকে অর্থাৎ ইনস্টিটিউটকে স্টারটেকের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়। এতে বলা হয়, চতুর্থ সর্বনি¤œ দরদাতার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও যেহেতু এখনো কোনো মালামাল বুঝে নেওয়া হয়নি, তাই উক্ত চুক্তি বাতিল করে সর্বনি¤œ দরদাতার (ওয়ালটন) সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। এ ছাড়া ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকতে এবং মূল্যায়ন কমিটি গঠনের সময় আবশ্যিকভাবে বহিঃসদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য নির্দেশনা দেয় রিভিউ প্যানেল। তবে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অর্থবছর শেষ হওয়ায় বরাদ্দকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত গিয়েছে। ফলে ওয়ালটনের সঙ্গেও এখন চুক্তি করার সুযোগ নেই।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী লুৎফর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়া আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগে হয়েছে। তাই আগে কী হয়েছে সে বিষয়ে জানি না। তবে আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর বিপিপিএর চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে সর্বনি¤œ দরদাতার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে বলা হলেও, এখন সেই সুযোগ নেই। চিঠি পেয়েছি ৩ জুলাই, এর আগেই ৩০ জুন অর্থবছর শেষ হয়েছে। যেহেতু এই ক্রয়ের জন্য কোন বিল জমা পড়েনি, তাই অর্থও খরচ হয়নি। অর্থবছর শেষ হওয়াতে সেই অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘আইবাস’ এ ফেরত গিয়েছে। নতুন অর্থবছরে আবারও যদি এই অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়, শিক্ষার্থীদের যেহেতু কম্পিউটার লাগবে, তখন নতুন করে দরপত্র আহবান করা হবে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তখন নতুন কার্যাদেশ দেওয়া হবে।’
এদিকে কার্যাদেশ পেলেও, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারেনি স্টারটেক। বিষয়টি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং স্টারটেক উভয় পক্ষই নিশ্চিত করেছে রূপালী বাংলাদেশকে। তবে দরপত্রে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে রূপালী বাংলাদেশের কাছে দাবি করেছেন স্টারটেকের চেয়ারম্যান রাশেদ আলী ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি, স্টারটেক সে ধরনের প্রতিষ্ঠান নয়। মূলত নির্ধারিত সময়ে কম্পিউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারিনি বলেই চুক্তি বাতিল হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
দরপত্রের ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, আদতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মত শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গবেষণার উপাত্ত অনুযায়ী, দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক শিক্ষাদান কার্যক্রমের তুলনায় প্র্যাকটিক্যাল (ব্যবহারিক) শিক্ষাদান কার্যক্রমের মান ওই অর্থে ভালো না।
পলিটেকনিক বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাবহারিক অনুশীলনই মূল। সেক্ষেত্রে কম্পিউটার এবং এর যন্ত্রাংশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তাদের জন্য। এ ধরনের ডিভাইস কখনো নতুন কিনতে হয়, আবার পুরোনোগুলোকে হালনাগাদ করতে হয়। এখানে যদি দীর্ঘসূত্রতা হয়, তাহলে অবশ্যই শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :