চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শৈলমারি গ্রামে বর্ষা এলেই বাড়ে ব্যস্ততা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ সবাই ডুবে থাকেন মাছ ধরার ফাঁদ ‘বিত্তি’ তৈরির কাজে। বাঁশ, তালগাছের আঁশের সুতা ও নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরি হয় এই বিত্তি। একদিকে প্রচেষ্টা, অন্যদিকে শিল্পÑ এই দুটি মিলে এখন গ্রামটি হয়ে উঠেছে কুটির শিল্পের একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্রে।
এই কাজে যুক্ত আছে গ্রামের প্রায় ২০০ পরিবার। তারা বছরের অর্ধেক সময় জুড়ে এই কাজ করেন। নিজেদের শ্রম আর দক্ষতায় তারা এখন আর্থিকভাবে অনেকটাই স্বাবলম্বী। একসময় যারা দিন এনে দিন খেত, এখন তারা সপ্তাহে আয় করেন কয়েক হাজার টাকা।
বিত্তি তৈরির প্রক্রিয়া কম পরিশ্রমের নয়। তালগাছের ডগা পচিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নিতে হয়, বাঁশ কেটে তৈরি করতে হয় কাঠামো। আর সেই কাঠামোয় সুতা জড়িয়ে তৈরি হয় ফাঁদ। এই কাজে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেন। নারী কারিগর সারেজান খাতুন বলেন, ‘সপ্তাহে তিন-চারটা বিত্তি বানাতে পারি। এতে সংসারের খরচে অংশ নিতে পারছি।’
কারিগররা জানান, প্রতিটি বিত্তি বাজারে বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। যশোর, মেহেরপুর, খুলনা, বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে এই গ্রামের বিত্তি কিনতে। যশোর থেকে আসা ক্রেতা হাসেম আলী বলেন, ‘শৈলমারির বিত্তি খুব টেকসই, দামও সাধ্যের মধ্যে।’
শুধু পুরুষ নয়, মেয়েরাও এই শিল্পের মাধ্যমে হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী। কেউ কেউ সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবেও কাজ করছেন। গ্রামের আনারুল ইসলাম জানান, ‘প্রতি সপ্তাহে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বিত্তি বিক্রি হয়।’ একেকটি বাঁশ কিনতে হয় ২০০ থেকে আড়াইশ টাকায়, আর তালগাছের ডগা ৩০ টাকায়।
প্রায় ৬০ বছর আগে এই গ্রামের দুটি হিন্দু পরিবার প্রথম বিত্তি তৈরির কাজ শুরু করে। সেখান থেকেই শিখে নেয় পুরো গ্রাম। এখন এই শিল্প হয়ে উঠেছে জীবনের অংশ। পার্শ্ববর্তী হরিশপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মুনতাজ আলী বলেন, ‘এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে সহায়তা দরকার।’
বেগমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. এরিং জানান, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বিত্তি কারিগরদের সহায়তা করা হয়। কাজ না থাকলে দেওয়া হয় খাদ্য ও অর্থ সহায়তা।
এ গ্রামে বিত্তি এখন শুধু মাছ ধরার উপকরণ নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, জীবিকার অবলম্বন আর মর্যাদার প্রতীক। শৈলমারির মানুষরা দেখাচ্ছেন অল্প উপকরণ আর পরিশ্রম দিয়েও গড়ে তোলা যায় এক টেকসই স্বপ্ন। এই স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন আরও প্রশিক্ষণ, পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি সহায়তা।