বরিশালে লিটন সিকদার ওরফে লিটু নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক এক নেতাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যারাতে সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের বিল্লবাড়ি গ্রামের গাজীবাড়িতে ওই নেতার বাসায় ঢুকে তাকেসহ পরিবারের লোকজনদের এলোপাতাড়ি কোপায় জাকির গাজীসহ তার লোকজন। এতে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) লিটু ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় তার মা, ভাই-বোনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জানা গেছে, এই হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া জাকির গাজী নিহত লিটুর বোনজামাই এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিল্টনের অনুসারী। বরিশাল মেট্রোপলিটন বিমানবন্দর থানা পুলিশ এই বিয়োগান্তক ঘটনায় গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল অভিযুক্ত জাকির গাজী ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের উপকণ্ঠ কাশিপুরের বিল্লবাড়ির লিটন সিকদার ওরফে লিটুর জামাতা জাকির গাজী কিছুদিন আগে গোপনে অন্যত্র একটি বিয়ে করেন। এই খবর চাউর হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যবসায়ী লিটু ও তার বোন মুন্নি আক্তার জাকিরকে ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। গত ২৭ জুলাই স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এই ঘটনায় জাকির গাজী সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দর থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্ত্রী এবং শ্যালক লিটুর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে একই দিন জাকির গাজীর বিরুদ্ধেও বিমানবন্দর থানায় যৌতুক দাবিসহ মারধরের অভিযোগে মামলা করেন মুন্নি বেগম।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাল্টাপাল্টি মামলাকে কেন্দ্র করে বিল্লবাড়িতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা লিটুর শাস্তির দাবি করে বোনজামাই জাকিরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলও হয়। শোনা যাচ্ছে, মাঠপর্যায়ে লিটুর শাস্তির দাবিতে জাকিরসহ গুটিকয়েক লোক সোচ্চার থাকলেও নেপথ্যে থেকে তাদের পরিচালনা করছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা মিল্টন। একাধিক মামলার আসামি লিটু একসময়ে মিল্টনের কাছের লোক থাকলেও স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক সাপেনেউলে। তা ছাড়া এই হত্যাকা-ে যাদের অভিযুক্ত করা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা মিল্টনের কর্মী-সমর্থক বলে জানা গেছে।
অবশ্য মিল্টনও এই তথ্য রূপালী বাংলাদেশের এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলছেন, বিল্লবাড়ির অধিকাংশ লোকজনই তার কর্মী-সমর্থক, অতীতে লিটুও তার কাছের লোক ছিলেন। কিন্তু দল থেকে বহিষ্কার করার পর থেকে লিটুর সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সূত্র জানায়, মিল্টনের সাথে সম্পর্কের অবনতির মধ্যেই মিল্টন বিল্লবাড়ি এলাকায় এককভাবে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। ৫ আগস্টের পর তিনি বেশ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়েন। সর্বশেষ তিনি বোনের জামাইকে ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। এ নিয়ে তার ওপর মিল্টনের অনুসারী বিল্লবাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা বেজায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার জাকিরের স্বজনেরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিপক্ষ মিল্টন-জাকিরের এই আক্রোশ এবং তাদের কোনো পূর্বপরিকল্পনায় বৃহস্পতিবার স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা বলি হলেন কি না সেটাও আলোচনার রসদ জুগিয়েছে।
অবশ্য ভাই হত্যাকা- নিয়ে মুন্নি আক্তার যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা আরও শোরগোল ফেলে দেওয়ার মতো। তিনি জানান, স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা মিল্টনের অনুসারী জাকির গাজীসহ সন্ত্রাসীরা এলাকায় ওঁত পেতে আছে, তা আগেভাগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাদের হাত থেকে বাঁচতে বৃহস্পতিবার জাকিরের মামলায় আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে পুলিশ সদস্যদের সাথে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। কিন্তু পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘরে ঢুকে মিল্টনের সন্ত্রাসী বাহিনী তাদের এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে এবং পিটিয়েছে। ঘটনার সময় জাকিরসহ একাধিক ব্যক্তিকে মিল্টনের সাথে মুঠোফোনে কথা বলতেও দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরে লিটুর মৃত্যু হলে পুলিশের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে পালিয়ে যায়।
উপস্থিত পুলিশের নীরবতায় সন্ত্রাসীদের তা-ব এবং প্রাণহানির ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। অবশ্য খুনের ঘটনার পরপর বিল্লবাড়িতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। একই সাথে ঘটনাস্থল থেকে বৃস্পতিবার রাতেই ৫ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় পুলিশ। পরে একই রাতে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল অভিযুক্ত জাকির গাজী পলাতক রয়েছেন।
পলাতক জাকির গাজীকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে এবং লিটু হত্যার সাথে নেপথ্য কোনো মাস্টারমাইন্ড জড়িত রয়েছে কী না তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এই তথ্য নিশ্চিত করেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) মো. রিয়াজ হোসেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, লিটু হত্যাকা-ে এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই হত্যাকা-ে প্রধান অভিযুক্ত জাকির গাজীকে গ্রেপ্তার করতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :