সময় বদলেছে, বদলেছে মানুষের জীবনযাপন। প্রযুক্তির প্রসারে বদলে গেছে গ্রামীণ বসতবাড়ির গড়নও। তবে এই আধুনিকতার ঢেউয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে একসময়ের গ্রামীণ আভিজাত্য ও সংস্কৃতির প্রতীক ‘কাচারি ঘর’।
কাচারি ঘর একসময় শুধু একটি মেহমানখানাই ছিল না; এটি ছিল সামাজিকতা, আতিথেয়তা এবং নিরাপত্তার এক দৃশ্যমান প্রতীক। গ্রামবাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ির বাইরে একটি আলাদা ঘর থাকত, যার বহু জানালা ও দরজা দিয়ে সহজেই আলো-বাতাস প্রবেশ করত। এই ঘরে বসতেন অতিথি, খাওয়া-দাওয়া চলত, চলত পারিবারিক বৈঠক, এমনকি কখনো নামাজও আদায় হতো। অনেক সময় পথচারী, মুসাফির বা লজিং মাস্টাররাও এখানেই রাতযাপন করতেন। আর এসব কারণেই হয়তো একসময় গ্রামে চুরি-ডাকাতির ঘটনাও ছিল খুবই কম।
কালের আবর্তে সেই কাচারি ঘরের ঠাঁই হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে হয়তো নাম শুনেছেÑ চোখে দেখেনি কখনো। কারণ, আধুনিক বাড়ির মূল কাঠামোতেই এখন সংযুক্ত থাকে ড্রয়িংরুম ও ডাইনিং স্পেস। ফলে মেহমান খাতিরদারির জন্য আলাদা ঘর রাখার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে গ্রামীণ সমাজে একসময় যে ঘরটি ছিল আভিজাত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিকতার প্রতীক, তা আজ শুধুই স্মৃতি।
নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার রাজপাড়া হাজীবাড়িতে এখনো একটি কাচারি ঘর চোখে পড়ে, তবে তার অবস্থাও অত্যন্ত জরাজীর্ণ। ঘরের চারদিকে আর কোনো বেড়া নেই, কেবল খুঁটির ওপর টিকে আছে চালাটি। মেঝে ভরে আছে শুকনো লাকড়িতে, যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে পুরো কাঠামোটি। একই চিত্র ঘাগড়া গ্রামের মোল্লাবাড়িতেও। যদিও এখানে কাচারিঘরের ভিটাটি এখন বিলীন হয়ে জায়গা নিয়েছে একটি দোতলা ভবন।
স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর বাশার সুমন বলেন, ‘আমরা দেখেছি এই কাচারি ঘরে বৈঠক বসত, কখনো নামাজ পড়া হতো, রোজায় সবাই একসঙ্গে ইফতার করতাম। এখন আমাদের বাসায়ই আলাদা ড্রয়িংরুম-ডাইনিং আছে, কাচারি ঘরের প্রয়োজনই পড়ে না।’
একসময় গ্রামের প্রতিটি সম্ভ্রান্ত বাড়িতেই কাচারি ঘর ছিল বাধ্যতামূলক। এটি ছিল অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের অন্যতম স্থান। আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায়, পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ধারায় ও বাস্তবতার কারণে কাচারি ঘর বিলীন হয়ে গেছে।
এটি শুধু একটি স্থাপত্যের ক্ষয় নয়, বরং গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিকতা হারানোর এক নিঃশব্দ সাক্ষ্য। এখন আর নতুন কোনো বাড়িতে কাচারি ঘর নির্মাণ হয় না। বরং যা ছিল তা-ও রয়ে গেছে অবহেলায়, জীর্ণতায়।
গ্রামীণ ঐতিহ্য রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার প্রয়োজনে এসব কাচারি ঘর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। স্থানীয় প্রশাসন, স্থাপত্য সংস্থা কিংবা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় চাইলে এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলো সংরক্ষিত ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করতে পারে, যা হতে পারে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বার্তা।
আপনার মতামত লিখুন :