১৬৯৯ সালে নির্মিত মুদ্রণযন্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে ময়মনসিংহে। সম্প্রতি পুরাকীর্তি সুরক্ষা কমিটি, ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রতিনিধি দল নগরীর মৃত্যুঞ্জয় স্কুল এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটি পরিদর্শন করেন। সে অনুযায়ী ময়মনসিংহে পাওয়া মুদ্রণযন্ত্রটি ৩২৬ বছর আগের। সেটিকে সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদনের কথা জানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোড এলাকায় দেখা যায়, মুদ্রণযন্ত্রটির দুটি অংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ছাপাখানার জায়গাটিও অরক্ষিত। তবে ছাপাখানাটি কবে বন্ধ হয়েছে স্থানীয়রা সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।
স্থানীয় চা-দোকানি সুশীল চন্দ্র দে বলেন, ১৯৯৭ সালে বাবার হাত ধরে সঙ্গে ময়মনসিংহ আসি। তখন থেকেই মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোডে বসবাস করছি। শুরুতে ২০ টাকা দিয়ে বাবা আর আমি বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করি। এখন আমার বাসা ভাড়া ৮ হাজার। ৯৭ সালে এসে দেখি টিনের চৌচালায় ছাপাখানা চলছে। এর কয়েক মাস পর থেকে অবশ্য সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ছাপাখানার কয়েকশ গজ দূরে একটি পত্রিকা অফিস ছিল। সেটিও এখান বের হতো।
গত ৬ আগস্ট নগরীর নগরীর মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোড এলাকায় পরিদর্শনে যান নবগঠিত পুরাকীর্তি সুরক্ষা কমিটি, ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রতিনিধি দল। সেখানে গিয়ে তারা পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি মুদ্রণযন্ত্রের দেখা পান। যার গায়ে তৈরির সন লেখা ছিল ১৬৯৯ সাল।
পরিদর্শন শেষে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে পুরাকীর্তি সুরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ইউরোপে ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুদ্রণশিল্পের প্রসার ঘটে। বিশেষ করে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে জার্মান উদ্ভাবক জোহানেস গুটেনবার্গ কর্তৃক ধাতব চলনশীল অক্ষর ব্যবহার করে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর হতে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশে ছাপাখানার প্রসার ঘটে পর্তুগিজদের হাত ধরে। ১৫৫৬ সালে গোয়ায় পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করে। এরপর ধীরে ধীরে এ প্রযুক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুদ্রণশিল্প প্রসারিত হতে থাকে। যার প্রভাব প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহেও পড়ে। মুদণযন্ত্রটি ১৬৯৯ সালে নির্মিত, যা মুদ্রণশিল্পের অনন্য নিদর্শন। পূর্বপ্রজন্মের প্রগতিশীল মানুষদের হাত ধরে এই প্রাচীন মুদ্রণযন্ত্রটির ময়মনসিংহে আগমন ঘটে।
পুরাকীর্তি সুরক্ষা কমিটির সভাপতিম-লীর সদস্য ও গবেষক স্বপন ধর বলেন, প্রামাণ্য কথা নামে আমার একটি চ্যানেল বের হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে মুদ্রণযন্ত্রটি গবেষণার তালিকায় রয়েছে।
তবে গবেষণা করতে গিয়ে যে বিষয়টি পাওয়া গেছে, ১৮৬৬ সালের দিকে হরচন্দ্র চৌধুরী শেরপুর থেকে মুদ্রণযন্ত্রটি ময়মনসিংহে নিয়ে আসছিলেন। তারপর ১৯৪৭ সালে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অনাথ বন্ধু গোহ তার প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানায় সেই মুদ্রণযন্ত্রটি ব্যবহার করতেন। তিনি কয়েক বছর ব্যবহারের পর গফরগাঁওয়ের মাওলানা পাঁচবাগীর হাতে ছাপাখানার দায়িত্বে চলে যায়, যা চলমান থাকে স্বাধীনতার পর পর্যন্ত। সেখান থেকে চাষী পত্রিকাসহ রাজনৈতিক প্যানা পোস্টার ছাপানো হতো।
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বশেষ ছাপাখানাটি কারা পরিচালনা করত তা বের করার কাজ চলছে। তবে আমরা চাই যেহেতু মুদ্রণযন্ত্রটি পুরাকীর্তির নিদর্শন স্বরুপ। তা সংরক্ষণের জন্য প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
ময়মনসিংহের স্থানীয় দৈনিক আজকের খবর পত্রিকার সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন, মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোডে ছাপাখানাটির নাম ছিল চাষী চাপাখানা। সাপ্তাহিক চাষী পত্রিকাটিও সেখান থেকে প্রিন্ট করা হতো। বিভিন্ন সময়ে ছাপাখানা হাত বদল হয়েছে। সবশেষ এটিএম নুরুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে ছিল ছাপাখানাটি।
কবি শামসুল ফয়েজ বলেন, ‘ছাপাখানাটি থেকে দৈনিক ইনসাফ পত্রিকা বের করতেন এটিএম নুরুদ্দীন। সেখানে আমার যাওয়া আসা ছিল। ছাপাখানাটি ৩০-৩৫ বছর আগে ছিল। এরপর নুরুদ্দীন সাহেব মারা গেলে তার ছেলেমেয়েরা আমেরিকা স্থায়ী হয়। পরে আর পত্রিকা বের হয়নি। ছাপাখানাটিও বন্ধ হয়ে যায়।’