পাঁচ ব্যাংক মিলিয়ে একটি ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠন করতে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে কোন খাত থেকে এই টাকা দেওয়া হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বাজেটে যে থোক বরাদ্দ রাখা আছে, তা চাহিদার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ। ফলে বিকল্প হিসেবে দুটি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চিন্তা করছে অর্থ বিভাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লভ্যাংশ থেকে অর্থ দেওয়ার আগ্রহ দেখালেও আইনগত কাঠামোর কারণে তা সম্ভব নয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও সরাসরি টাকা দিতে পারবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে অর্থ বিভাগের হাতে থোক বরাদ্দ আছে চার হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ পুরোটা দিলে আপৎকালীন প্রয়োজন মেটাতে অর্থ বিভাগের হাতে আর কোনো অর্থ থাকবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের লভ্যাংশ থেকে পাঁচ ব্যাংকের জন্য অর্থ দেওয়ার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের লভ্যাংশ পুরোটা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের লভ্যাংশ মূলত সরকারের নন-ট্যাক্স রেভিনিউর একটি খাত। তাই এ অর্থ খরচ করার কোনো এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই, খরচের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই সরকারের হাতে।
অর্থ বিভাগের তিনটি সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছে, পাঁচ ব্যাংক মিলিয়ে একটি ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠনের জন্য সরকারের কাছে যে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে, তা দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর এ অর্থ সংগ্রহ করতে অর্থ বিভাগ দুটি মাধ্যম ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে। প্রথম মাধ্যম হলোÑ বাজেটে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সব মন্ত্রণালয়ই তা পুরোপুরি ব্যয় করতে পারে না। ফলে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট জানুয়ারির মধ্যে প্রণয়ন করে ওইসব মন্ত্রণালয়ের অব্যবহৃত টাকা একত্র করে পাঁচ ব্যাংকের মূলধন হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। এতে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে না, সমস্যারও সমাধান হবে।
একই সূত্র জানিয়েছে, অর্থ সংগ্রহের জন্য সরকারের দ্বিতীয় চিন্তা হলোÑ বন্ড বা ট্রেজারি বিল বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা। এতে সরকারের ওপর সুদের চাপ বাড়বে, তবে দ্রুত সময়ে অর্থ সংগ্রহের জন্য ট্রেজারি বিলকেই সবচেয়ে সহজ উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, বন্ড তুলনামূলক সময়সাপেক্ষ হলেও ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে দ্রুত টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে সূত্রটি জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ট্রেজারি বিল বিক্রি করে, সরকার চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অতিরিক্ত ট্রেজারি বিল বিক্রি করেও টাকা সংগ্রহ করতে পারে। সরকার যে পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করবে, তা শুধু ট্রেজারি বিল বিক্রির ক্যালেন্ডারে উল্লেখ করে দিতে হবে। তা ছাড়া একসাথে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে না। এই অর্থ ধাপে ধাপে দেওয়া হবে, আর সরকারও ধাপে ধাপে বিল বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে দিতে পারবে।
জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সমস্যায় পড়া পাঁচটি ইসলামি ধারার ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে সরকারও। এই পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে একটি ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠন করা হবে। সেটির জন্য প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেবে সরকার। তবে নতুন এই ব্যাংকের মূলধন হবে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংক হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে চারটিই ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ও ব্যাপক সমালোচিত ব্যক্তি এস আলমের মালিকানায়। আর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারও ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ।
পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ কার্যক্রমটি এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। এ জন্য সময়ভিত্তিক কর্মকৌশল চূড়ান্ত করতে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ভিত্তিক কর্মকৌশল চূড়ান্ত করে ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহম্মদের নেতৃত্বে এই ওয়ার্কিং কমিটি কাজ করবে। এ কমিটিতে অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে।
গত রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে আয়োজিত এক সভায় এসব আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী) আনিসুজ্জামান চৌধুরী, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সভা সূত্রে জানা যায়, এই ব্যাংক একীভূত করার আগে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ব্যাংকটির সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামি ব্যাংক’। সরকারের মূলধনে এই ব্যাংক গড়ে উঠবে। একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় এই ব্যাংকের অধীনে চলে আসবে। এরপর ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করবে। এই ব্যাংক মুনাফা করতে শুরু করলে এর শেয়ার বেসরকারি খাতে ছাড়বে সরকার। এর মাধ্যমে সরকার বিনিয়োগ ফেরত নেবে। পাশাপাশি পাঁচ ব্যাংকের বড় আমানতকারীদেরও শেয়ার নেওয়ার প্রস্তাব করা হবে। ছোট আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে চাইলে তাতে বাধা দেওয়া হবে না। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংককে নিয়ে শুনানি করেছে। শুনানিতে ব্যাংকগুলোর কাছে শেষবারের মতো জানতে চাওয়া হয় কেন তাদের একীভূতের আওতায় আনা হবে না। এর মধ্যে বিনা বাক্যে একীভূত হতে সম্মত হয় তিনটি ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। তবে একীভূত হওয়ার তালিকায় থাকা অন্য দুটি ব্যাংক সময় চায়। ব্যাংক দুটি হলো এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশি-বিদেশি নিরীক্ষকদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে জানিয়ে দিয়েছে, একীভূত হওয়া ছাড়া এসব ব্যাংকের জন্য আর কোনো পথ খোলা নেই।
এই বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ ব্যাংক মিলিয়ে একটি ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সাথে তারা একমত হয়েছেন। এই বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বও বদল হয়। গভর্নরের দায়িত্ব পান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক লুটপাটের শিকার হওয়া বেশকিছু ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেন। শেষ পর্যন্ত তা উল্লিখিত পাঁচটিতে এসে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, ব্যাংক একীভূত হবেই, এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এতে আমানত নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকবে। সরকার আমানতকারীদের দায়িত্ব নেবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন