‘একসময় আমাদের দিন চলত বনের কাঠ বিক্রি করে। তাতে বন নষ্ট হতো, জীবনও অনিশ্চিত ছিল। এখন বন রক্ষা করেই আয় করছি, ঘরে স্বস্তি ফিরেছে।’ বলছিলেন কক্সবাজারের রামু জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বপাড়া এলাকার আনোয়ারা বেগম। তিনি একজন সুফল প্রকল্পের উপকারভোগী।
তার মতো আরও শত শত নারী ও পুরুষ বননির্ভশীলতা কমিয়ে বিকল্প জীবিকায়নের মাধ্যমে এখন বন রক্ষায় ভূমিকা রাখছেন। এতে করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন পাহাড়ে একসময়ের উজাড় দৃশ্য এখন আর নেই। সরকারি উদ্যোগে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের মাধ্যমে পাহাড়ে সবুজে ভরে উঠেছে নতুন জীবন। শুধু গাছই নয়, বননির্ভর হাজারো মানুষের জীবনে এসেছে স্থিতি ও স্বস্তি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে শুরু হওয়া সুফল প্রকল্প কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে হাজার হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে বনায়নের ব্যবস্থা করে। ২০২৩ সালে সুফল প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও এর সুফল এখন দৃশ্যমান।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প চলাকালে দেড় লাখেরও বেশি বননির্ভর মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছে। পাহাড়জুড়ে দেশীয় প্রজাতির সেগুন, গর্জন, গামারি, শালসহ নানা বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। ফলে জীববৈচিত্র্য ফিরছে, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলও তৈরি হচ্ছে।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ১০টি রেঞ্জের মধ্যে আটটিতে ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাপক বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে বন বিভাগ। এই সময়ের মধ্যে মোট ৮৪৭১ হেক্টর বনভূমিতে নতুন বনায়ন সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব বনায়ন এখন সবার দৃষ্টি কাড়ছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের বনায়নের মধ্যে রয়েছেÑ এএনআর ২৯৪.০ হেক্টর, এনরিচমেন্ট ১৩১৭.০ হেক্টর, স্বল্পমেয়াদি ৫৫৯২.০ হেক্টর, দীর্ঘমেয়াদি ১০৪০.০ হেক্টর, বিরল ও বিপন্ন ৯০.০ হেক্টর, বাঁশবাগান ২০.০ হেক্টর, এনটিএফপি ১০.০ হেক্টর, ঔষধি ৮৫.০ হেক্টর, স্ট্রিপ প্লানটেশন করা হয়েছে ৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া সেগুন কপিচ ব্যবস্থাপনা ২০.০ হেক্টরসহ ৮৪৭১ হেক্টর বনায়ন সৃজন করা হয়েছে।
বনসংলগ্ন ৫৭টি গ্রামে গঠন করা হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও বন ব্যবস্থাপনা কমিটি (এসসিভি)। সুফল বনায়নের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার ৮০০ জন সুবিধাভোগী। এর বাইরে বননির্ভর জীবিকা থেকে সরে এসে বিকল্প আয়মুখী কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৩৭৮ নারী-পুরুষ, যাদের মধ্যে ১৪ কোটি ১৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ নিয়ে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
মমতাজ বেগম নামে একজন নারী জানালেন, আগে তিনি বাঁশ-কাঠ কেটে বাজারে নিতেন, বিক্রি করতেন। পুলিশি ও বন বিভাগের ঝামেলাও ছিল। এখন তিনি গরু ও ছাগল পালন করে লাভবান। এতে বনও বেঁচে যাচ্ছে, তারাও ভালো আছেন বলে জানান। এমন উদাহরণ কক্সবাজার জেলাজুড়ে অসংখ্য। কারও হাতে এখন হাঁস-মুরগি বা ছাগল পালনের ব্যবসা, কেউ মুদি দোকান কেউবা পেয়েছেন কৃষিকাজের সহায়তা। এসব ব্যবসা থেকে আয় করে সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছেন, সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা। এসব বনায়ন রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে ১ হাজার ২৬ জন কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ (সিপিজি) সদস্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব সিপিজি সদস্য নিয়মিত টহলের মাধ্যমে সৃজিত বাগানগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। সিপিজি সদস্যদের সম্মানী বাবদ ৫১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রদান করেছে বন বিভাগ। সুফল প্রকল্পের অর্থায়নে বন উন্নয়নে এরই মধ্যে চারটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন রেঞ্জে।
বন বিভাগ জানায়, সৃজিত বাগানে জীবিত চারার গড় টিকে থাকার হার ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশ।
সরেজমিনে জোয়ারিয়া নালা রেঞ্জের অধীনে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৃজিত সুফল বনায়ন ঘুরে দেখা গেছে, ফলদ, ঔষধি ও বনজ চারাগুলো আশানুরূপ বর্ধন হয়েছে। সব দিক ভরে গেছে সবুজে। দৃষ্টিনন্দন বনায়নের ফলে হারানো জীববৈচিত্র্য ফিরতে শুরু করেছে বাগান এলাকায়। সবখানে পাখির কলতানে মুখর থাকছে।
বিশেষ করে বন্য হাতির আবাসস্থল উন্নত হওয়ায় মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব কমে এসেছে। ফলে লোকালয়ে হাতির প্রবেশও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
সুফল প্রকল্পের কারণে বনজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য বাড়ছে। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘পাহাড় এখন আগের মতো নির্জন নয়, প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।’ জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম কবির উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘এখানে বন ও জীবিকা একসঙ্গে পরিকল্পিত হয়েছে। মানুষকে বিকল্প জীবিকায়ন না দিলে বন টিকে থাকত না। সুফল প্রকল্প সেই ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
তিনি আরও জানান, বনায়নের কারণে হরিণ, খরগোশ, বন্যপ্রাণী, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, এমনকি বানরও এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। এটি পাহাড়ি পরিবেশের জন্য ইতিবাচক সংকেত।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদী নেতা কামরুল হাসান মনে করেন, সুফল প্রকল্প শুধু একটি বনায়ন কর্মসূচি নয়, এটি একটি টেকসই উন্নয়ন মডেল। তিনি বলেন, ‘এখানে বন ও জীবিকা একসঙ্গে পরিকল্পিত হয়েছে। মানুষকে বিকল্প জীবিকায়ন দেওয়ায় তারা আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে পরিবেশ রক্ষা করে নিজেরাও স্বস্তিতে বেঁচে থাকার।’
স্থানীয় বাসিন্দারা চান, এই প্রকল্পের ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। উপকারভোগী আয়েশা বেগমের ভাষায়, ‘আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা সবুজ পাহাড়ে বড় হোক। বন যদি টিকে থাকে, আমাদের জীবনও টিকবে।’
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মারুফ হোসেন বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, আগে যেখানে পাহাড়ি বনভূমিতে পাখি বা হরিণ, বন্যপ্রাণী খুব একটা দেখা যেত না, এখন সেগুলো ফিরছে। এটি আমাদের কাছে বড় প্রাপ্তি।’
তিনি আরও বলেন, এই ধারাবাহিক বনায়ন কার্যক্রম শুধু বন ও পরিবেশ নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রকল্প শেষ হলেও এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই অর্জন ধরে রাখা। তিনি বলেন, প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়েই কেবল কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের পাহাড় সবুজে টিকে থাকবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেবে জীবন ও স্বস্তি।