ঢাকা রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

বিশ্বসেরা উদ্ভাবনের তালিকায় আইসিডিডিআর’বির  অন্ত্র-সুস্থকারী খাবার

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম

বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকী প্রকাশ করেছে তাদের বার্ষিক ‘টাইম শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন ২০২৫’ তালিকা, যেখানে ‘সামাজিক প্রভাব’ বিভাগে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর’বি ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে উদ্ভাবিত অন্ত্র-সুস্থকারী খাবারÑএমডিসিএফ-২। এই স্বীকৃতি প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের গবেষণা বিশ্বমানের উদ্ভাবনের কাতারে পৌঁছে গেছে।

এই খাবারটির পূর্ণ নাম মাইক্রোবায়োটা ডিরেক্টেড কমপ্লিমেন্টারি ফুড অর্থাৎ এমন একটি সম্পূরক খাদ্য যা মানুষের অন্ত্রে থাকা উপকারী জীবাণুগুলোর পুষ্টি সরবরাহ ও বৃদ্ধি ঘটিয়ে শরীরের ভেতরের পুষ্টি শোষণ প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করে তোলে। বিশেষত যারা দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের অন্ত্রের জীবাণু ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এমডিসিএফ-২ সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে এবং শিশুর বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও স্নায়বিক বিকাশে সহায়তা করে।

গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আইসিডিডিআর’বি। আইসিডিডিআর’বি জানিয়েছে, এই খাবারটি তৈরি হয়েছে ছোলা, সয়াবিন, চিনাবাদাম ও কাঁচা কলার গুঁড়োর একটি বিশেষ মিশ্রণ দিয়ে। উপাদানগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে তা অন্ত্রে থাকা নির্দিষ্ট উপকারী জীবাণুগুলোর জন্য উপযুক্ত খাদ্য হিসেবে কাজ করে। ফলে জীবাণুগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়ে শরীরে পুষ্টি শোষণের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে যা অপুষ্ট শিশুর দ্রুত আরোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি বিকাশে সহায়ক হয়।

আইসিডিডিআর’বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেফরি গর্ডনÑ এই দুই গবেষকের মধ্যে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনা থেকেই এই উদ্ভাবনের সূত্রপাত। বহু বছর ধরে শিশুদের অপুষ্টি নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করছেন ড. তাহমিদ, আর ড. গর্ডন বহু বছর ধরে মানুষের অন্ত্রের জীবাণু জগৎ বা মাইক্রোবায়োম নিয়ে কাজ করছেন।

ড. গর্ডন বলেন, শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি ও পুষ্টি গ্রহণে অন্ত্রের জীবাণুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে উপকারী জীবাণুগুলো চিহ্নিত করেছি, তারা এমন সব খাদ্য উপাদান প্রক্রিয়াজাত করতে সাহায্য করে, যা মানবদেহ নিজেরাই করতে পারে না। বাংলাদেশে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, এমডিসিএফ-২ শিশুদের অন্ত্রের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বিকাশে আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলছে।

অন্যদিকে ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য গর্বের, কারণ এটি দেখিয়ে দিয়েছেÑ বিজ্ঞান ও মানবিক সহমর্মিতা একত্র হলে জটিল স্বাস্থ্য সমস্যারও সমাধান সম্ভব। এমডিসিএফ-২ স্থানীয়ভাবে তৈরি, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর একটি উদ্ভাবন, যা অপুষ্ট শিশুদের শুধু বাঁচিয়ে রাখবে না, তাদের স্বাভাবিক বিকাশেরও সুযোগ করে দেবে।

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, বাস্তুচ্যুতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অপুষ্টির হার বাড়ছে। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকই অপুষ্টিজনিত জটিলতার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশেও খর্বতা (বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম) ও কৃশতা (ওজন কম) এখনো জনস্বাস্থ্যের বড় উদ্বেগের কারণ। এমন প্রেক্ষাপটে এমডিসিএফ-২ এক নতুন আশার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, মালি ও তানজানিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে বৃহৎ পরিসরে এই খাবারের কার্যকারিতা যাচাইয়ের গবেষণা চলছে। 

গবেষকরা বলছেন, এমডিসিএফ-২ সফলভাবে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করা গেলে এটি বৈশ্বিক পুষ্টি কর্মসূচিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

পুষ্টিবিদদের মতে, এই উদ্ভাবন শুধু অপুষ্টি প্রতিরোধেই নয়, বরং ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল দেশের জনস্বাস্থ্য নীতিতে নতুন পথ দেখাবে। কারণ এটি দামি আমদানি করা চিকিৎসা বা খাদ্য পণ্য নয়Ñ স্থানীয় উপাদান থেকেই তৈরি, যা টেকসই ও সহজলভ্য সমাধান হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সুনাম আরও বাড়াবে।