ভঙ্গুর সড়কব্যবস্থা এবং ঝুঁকিপূর্ণ রেল যোগাযোগের উন্নয়নের দাবিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সিলেট। দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে এসেছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মী, ধর্মীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মাঠে নেমেছেন সিলেটের সাধারণ মানুষও। তারা একজোটÑ রাজধানীর সঙ্গে সিলেটের সড়কব্যবস্থার উন্নতি, রেলের আধুনিক ইঞ্জিন এবং নতুন একাধিক রেল নামাতে হবে। পাশাপাশি সিলেট-ঢাকা রুটে বিমানভাড়া সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে।
এসব দাবিতে গতকাল রোববার এক ঘণ্টার জন্য থেমে গিয়েছিল সিলেট। বন্ধ ছিল গাড়ির চাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য। দুপুরে রাজপথে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আহ্বানে আয়োজন করা হয় সমাবেশের। সেখানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সিলেটবাসী এসে যোগ দেন।
এর আগে একাধিক সামাজিক সংগঠন একই দাবিতে সিলেটে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। গঠিত হয়েছে সংগঠনও। আট দফা দাবি বাস্তবায়ন আন্দোলন পরিষদ কুলাউড়া-সিলেট রেলওয়ে উন্নয়ন ফোরাম, বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যান ফোরাম, সিলেটÑ এ রকম বিভিন্ন ব্যানারে কুলাউড়া ও সিলেটে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতা, অব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় অবহেলায় সিলেটবাসীর দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এ নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ। ধীরে ধীরে দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সিলেটবাসী।
রোববার (১২ অক্টোবর) এক ঘণ্টার প্রতীকী ধর্মঘট পালন করেন তারা। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরীর অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। শহরের প্রাণকেন্দ্র কোর্ট পয়েন্টে অনুষ্ঠিত হয় এক কেন্দ্রীয় প্রতিবাদ সমাবেশ।
সাবেক সিটি মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরীর আহ্বানে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সামাজিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা সংহতি জানান। বক্তারা অভিযোগ করেন, বছরের পর বছর ধরে সিলেটের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর ফলে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়েছে বহু গুণে।
সমাবেশে সিলেটবাসীর ৭ দফা দাবির একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীতকরণ কাজ দ্রুত শেষ করা, সিলেট-ঢাকা রুটে ডাবল লাইনের ট্রেন চালু এবং ট্রেনসংখ্যা বৃদ্ধি, বিমান টিকিটের দাম যৌক্তিক করা, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন, সিলেটে পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, পর্যটন খাতে বিশেষ বরাদ্দ এবং রেল টিকিটের কালোবাজারি বন্ধ।
প্রতিবাদ শেষে আরিফুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলমের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। দাবিসমূহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।’
এর আগে আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে চৌহাট্টা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শুরু হয় তরুণদের অনশন কর্মসূচি। তরুণ সমাজসেবী আব্দুল্লাহ আল মামুন সুজনের নেতৃত্বে চলমান এই অনশনে আরও কয়েকজন তরুণ যোগ দেন। দাবিগুলো একই : সিলেটের যোগাযোগ, শিক্ষা, পর্যটন ও বিমানসেবা খাতে অবিলম্বে উন্নয়ন ও বাজেট বরাদ্দ।
অনশনকারীরা জানান, সিলেটের উন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। তাদের ভাষায়, ‘এই অবস্থা চলতে পারে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে।’ রাতে অনশনস্থলে ছাত্র-জনতা ও সচেতন নাগরিকদের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। পরে সিলেটের জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম ঘটনাস্থলে গিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে তাদের আশ^স্ত করে সড়ক থেকে ঘরে ফিরিয়ে দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়নের আওতায় আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ প্রায় আট বছর ধরে চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কাজের স্থগিতাদেশ এবং সামগ্রী চুরির ঘটনায় প্রকল্পের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে মহাসড়কে যানজট, সময় নষ্ট ও দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সিলেটের উন্নয়ন পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
প্রতীকী ধর্মঘট ও অনশন কর্মসূচির পাশাপাশি আজ সোমবার দক্ষিণ সুরমার হুমায়ূন রশীদ চত্বরে গণ-অবস্থান ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ১৫ দিনের মধ্যে দাবিসমূহ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ না দেখা গেলে পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ‘সর্বাত্মক আন্দোলন’ ঘোষণা করা হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ইস্যুতে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে। তরুণরা বলছেন, উন্নয়ন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক হলে বৈষম্য আরও বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় সংহতির জন্য হুমকি।
সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, এই আন্দোলন এখন আর দলীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি একটি নাগরিক ঐক্যের প্রতিচিত্র। সিলেটবাসী মনে করেন, তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলন আর শুধু একটি দলের বা গোষ্ঠীর নয়, এটি এখন একটি নাগরিক আন্দোলন।