মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন হলো ঝিনাইদহের শৈলকুপা শাহী মসজিদ। কুমার নদের তীরে অবস্থিত এই মসজিদটি কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং ইতিহাস ও স্থাপত্য শিল্পের এক জীবন্ত জাদুঘর।
ধারণা করা হয়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র নাসির শাহ্ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। বাংলার সুলতানি যুগে নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ নামে একজন শাসক তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পূর্বপুরুষ। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার সুলতানি যুগের একজন বিখ্যাত শাসক ছিলেন। তিনি হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার শাসনকালে বাংলা স্বর্ণযুগের সম্মুখীন হয়। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক স¤পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন করেন।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী এবং ব্যবহৃত উপকরণ থেকে অনুমান করা যায়, এটি মধ্যযুগের সুলতানি আমলে নির্মিত হয় আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে। বিগত শতাব্দীগুলোতে মসজিদটি বহুবার সংস্কার করা হয়েছে। এই সংস্কারের ফলে মসজিদের আদি কাঠামো কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং নির্মাণকাল নির্ধারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সাথে মিলে যায়। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও স্থাপত্যবিদ এই মসজিদটিকে সুলতানি আমলের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটি একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ। যদিও নির্মাণের সঠিক তারিখ জানা যায়নি, তবে স্থাপত্যশৈলী ও বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মতামতের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়, এটি সুলতানি আমলে নির্মিত হয়েছিল।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত চমৎকার ও জটিল। লাল রঙের ছোট ছোট ইট দিয়ে নির্মিত এই মসজিদে প্লাস্টারবিহীন চুন, সুড়কি, ইটের গাঁথুনি দেখা যায়। মসজিদের চার কোণে চারটি গোলাকার উঁচু মিনার, পাঁচ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দুইটি স্তম্ভ, সাতটি প্রবেশ পথ ও ৩টি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের উত্তর দিকে একটি পুকুর এবং পূর্ব দিকে ৩০-৪৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি মাজার রয়েছে। মাজারে ঘুমিয়ে আছেন শাহ সৈয়দ আব্দুল কাদের বাগদাদী এবং শাহ মোহাম্মদ আরেব ই রব্বানী (আরব শাহ্)। তাদের সাথে আরও ছয়জন আউলিয়ার মাজার আছে, যাদের সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। বহু প্রাচীন এই মসজিদকে ঘিরে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
কিংবদন্তিগুলো বেশির ভাগই মসজিদের নির্মাণ, এর স্থাপত্য এবং এর সাথে জড়িত লোকদের জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। একটি প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, কোনো এক সুলতান রাতে একটি স্বপ্ন দেখে ঐশ্বরিকভাবে এই স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ পান। স্বপ্নের বার্তা অনুযায়ী এই স্থানে এসে মসজিদ, মসজিদের সামনে একটি বিশাল পুকুর এক রাতে নির্মাণ করেন। প্রধান ফটকসহ আরও বেশকিছু কাজ শেষ না করতেই সকাল হয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে, এ এলাকার লোকজন সকালে ঘুম থেকে উঠে এই স্থানে একটি পুকুরসহ ছয় গুম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ দেখতে পান। অনেকে বিশ্বাস করেন, মসজিদের অলৌকিক শক্তি আছে। আবার কারো বিশ্বাস, এই মসজিদে দোয়া করলে মনের মতো ফল পাওয়া যায়। এখনো প্রতিদিন বিশেষ করে শুক্রবার জুমার দিন এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানত, শিরনি, নগদ হাজার হাজার টাকা আসে।
কুমার নদের তীরে অবস্থিত এই মসজিদ নিয়ে নদীর সাথে জড়িয়েও অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। মসজিদটি নির্মাণের সময় নদীর স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল, মসজিদের পুকুরের সাথে তল দিয়ে নদীর সংযোগ আছে ইত্যাদি।
শৈলকুপা শাহী মসজিদ কেবল ধর্মীয় স্থান হিসেবেই নয়, বরং একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হিসেবেও পরিচিত। প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এই মসজিদ দেখতে আসেন। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস এবং শান্ত পরিবেশ দর্শনার্থীদের মন মাতিয়ে তোলে।
শৈলকুপা শাহী মসজিদ বাংলাদেশের অতীতের স্মৃতিচিহ্ন এবং স্থাপত্য শিল্পের একটি অমূল্য উপহার। এই মসজিদকে সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন