সরকারি তিতুমীর কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় একটা ইলেকট্রনিক প্রোডাক্ট নিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিভিন্ন পণ্য অর্ডার করে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেও আজ পর্যন্ত কোনো পণ্য পাইনি, টাকাও পাইনি। আমার মতো হাজার হাজার ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের পণ্য দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা আর কোনোদিন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছি নাÑ কথাগুলো বলছিলেন ই-কমার্স কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তি জসিম হোসেন। তিনি বলেন, ই-কমার্স কেলেঙ্কারির মূলহোতা গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানাকে দেশে কবে ফেরত আনা হবে। আনবেনিয়ায় গ্রেপ্তার হওয়া এই প্রতারককে দেশে ফিরিয়ে আনতে কোনো সরকারই চেষ্টা করছে না। হাজার হাজার গ্রাহক তাদের টাকা কি ফেরত পাবে?
মো. সুমন নামের আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, মাঝে মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য পেয়ে থাকি সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং টাকা ফেরত পাবে গ্রাহকরা। সেই কত বছর ধরে এসব শুনে আসছি কিন্তু পাচ্ছি না। তা ছাড়া বর্তমান সরকারের এই বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। আমরা যারা এর গ্রাহক ছিলাম তারা তো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু কোনো সাপোর্ট পাইনি। এদের ব্যবসা খুলতে যারা সহযোগিতা করেছে, অনুমতি দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ই-অরেঞ্জ ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য কেনা-বেচার কাজ করত। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে পণ্যের অগ্রিম টাকা নিলেও সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করায় এবং পরবর্তীতে অর্থও ফেরত না দেওয়ায় গ্রাহক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি পরে টাকা আত্মসাতের মামলায় জড়িয়ে পড়ে, যার তদন্ত চলমান। প্রতিষ্ঠানটির মূলে ছিলেন বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা। তিনি আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের হোতা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ও ইন্টারপোলের সূত্রমতে, সোহেল রানা প্রায় গত ১ বছর ধরে আলবেনিয়ার কারাগারে আটক আছেন। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং শেখ হাসিনার আত্মীয় হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। তার বিষয়টি আলবেনিয়াতে গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। সম্প্রতি আলবেনিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে সোহেল রানার বিষয়ে বিভিন্ন বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি কী কারণে বাংলাদেশ ছেড়েছেন এবং দেশে ফিরলে তার মৃত্যুদ- হতে পারে কি না, সেই বিষয়টি সামনে আসছে।
সূত্রমতে, ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে গ্রাহকের বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০২১ সালে মামলা হলে সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আলবেনিয়ায় গ্রেপ্তার হন। তার নামে প্রতারণা মামলা হয়। পরবর্তীতে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের হয়, যার তদন্ত এখনো চলছে। এ ছাড়া আর্থিক অনিয়মের কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ সম্পদের হিসাব চেয়েছিল, যা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতার অভাবকে নির্দেশ করে। এরপরে প্রতারণার অভিযোগে এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু অনলাইনে নয়, দ্বিগুণ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এক গ্রাম থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে, যা এর প্রতারণামূলক কাজের পরিধিকে আরও বড় করে। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সোহেল রানা গা-ঢাকা দিয়ে পালিয়ে যান। তাকে পালাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা করে বলে বিশেষ একটি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সোহেল রানার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি আছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আলবেনিয়াকে একাধিক চিঠি দেওয়া হলেও কোনো জবাব মেলেনি। সোহেল রানা দেশে ফিরলে মৃত্যুদ- হতে পারেÑ এমন একটি ভুয়া হত্যা মামলার তথ্য আলবেনিয়ার আদালতে জমা দিয়ে প্রত্যর্পণ ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ঢাকায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে ৯টি মামলা হয়। তার ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে ডিবি পুুুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সোহেল রানাকে দেশে ফেরত পাঠাতে আলবেনিয়ার পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের সেসব চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। তিনি এখন আলবেনিয়ার কারাগারে আছেন বলে জানা গেছে।
ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে প্রতারণা করে গ্রাহকের বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা হলে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান। ভারত থেকে নেপালে যাওয়ার চেষ্টাকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে গ্রেপ্তার হন। ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় সোহেল রানার দুই বছরের কারাদ- ও ৪০ হাজার রুপি জরিমানা করা হয়। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কারাগারে ছিলেন। ‘শারীরিক অসুস্থতা’ দেখিয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি কলকাতা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে লাপাত্তা হন। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সোহেল রানাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা হয়েছিল। বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালিও করা হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। সোহেল রানা ভারত থেকে পালিয়ে পর্তুগাল হয়ে আলবেনিয়ায় গিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আলবেনিয়ার পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবির কাছ থেকে এ তথ্য জানতে পারে বাংলাদেশ পুলিশ।
সোহেল রানা স্ত্রী, বোন, ভগ্নিপতি নিয়ে গড়ে তোলেন ই-অরেঞ্জ: ২০২০ সালের দিকে দেশে ই-কমার্স খাতের দ্রুত বিস্তার ঘটে। এসব বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সে সময়ই বনানী থানার তৎকালীন পরিদর্শক সোহেল রানা তার স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন, ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানকে নিয়ে গড়ে তোলেন ই-অরেঞ্জ নামের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। পরে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা শুরু করে। এসব কারণে মামলা হলে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন সোহেল রানার বোন সোনিয়া ও তার স্বামী মাশুকুর। তবে সম্প্রতি তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সোহেল রানার স্ত্রী নাজনীন পলাতক।
নানা প্রলোভন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। মামলার পর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে। পরে তার নামেও মামলা হয়। মামলার পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানায় পুলিশ। নানা প্রলোভন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। এক বছরের মাথায় গ্রাহকেরা বুঝতে পারেন, তারা ই-অরেঞ্জের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সিআইডির পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন জানানো হয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আবার ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন জানানো হয়। জানতে চাইলে সিআইডির মুখপাত্র ও বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান বলেছেন, সোহেল রানার নামে মানি লন্ডারিং মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখনো কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩৫৮ কোটি টাকার অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন