ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫

ডাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে ভোলার অর্থনীতি

খলিল উদ্দিন ফরিদ, ভোলা
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

নদী, নৌকা আর মাছ এই তিনটি শব্দই বহুদিন ধরে ভোলার পরিচয় বহন করেছে। মেঘনা-তেঁতুলিয়ার ¯্রােতধারাঘেরা এই দ্বীপজেলা যেন ছিল জেলেদের জীবনকথার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সময় বদলেছে। একসময় যেখানে সাগরের নোনাজলের ভয়ে কৃষকরা আবাদ করতে সংকোচ বোধ করতেন, সেই জমিতেই এখন সারি সারি ডাবগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ভোলা আজ শুধু নদী-মাছের জেলা নয়, ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে দেশের নতুন ‘ডাবের জেলা’ হিসেবে।

বাংলাদেশের দ্বীপের রানীখ্যাত জেলা ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়াবেষ্টিত সবুজ শ্যামল এক অঞ্চলে নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে ডাব চাষ। এখন অনেকের মুখে একটা কথাই শোনা যায়Ñ ‘ডাবেই ভোলার ভাগ্য বদলাচ্ছে’।

ভোলার অনুকূল আবহাওয়া, লবণাক্ততা সহনশীল মাটি এবং নদীঘেরা প্রকৃতি নারকেলগাছ বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে দেখা যায় এক বা একাধিক নারকেলগাছ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাষাবাদ আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, এখন এটি রূপ নিয়েছে বাণিজ্যিক উৎপাদনে।

মনপুরা, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও দৌলতখান উপজেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে হাজার হাজার একর জমিতে ডাব চাষ হচ্ছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, ধান বা অন্য ফসলের তুলনায় ডাব চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম, কিন্তু আয় অনেক বেশি।

লালমোহনের কৃষক মোজাম্মেল মিয়া বলেন, ‘আগে ধান চাষ করতাম, লাভ হতো না। এখন এক একর জমিতে প্রায় ৮০/১০০টি নারকেলগাছ আছে। বছরে কয়েকবার ডাব বিক্রি করা যায়, ফলে সারা বছর আয় থাকে।’

একসময় মৌসুমি আয়ের ওপর নির্ভরশীল কৃষকরা এখন সারা বছর ডাব বিক্রি করে উপার্জন করছেন। এতে শুধু কৃষকের জীবনযাত্রার মানই উন্নত হয়নি, বেড়েছে গ্রামীণ অর্থচক্রের গতি।

ভোলার ডাব এখন শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, বরং দেশের বড় শহরগুলোতেও ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। প্রতিদিন ভোলা থেকে শত শত ট্রাক ও লঞ্চযোগে ডাব ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটের বাজারে যাচ্ছে। ডাব পরিবহনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরিবহন শ্রমিক, মাঝি, পাইকার ও ব্যবসায়ীসহ হাজারো মানুষ।

এখন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা অনলাইনেও ডাব বিক্রি শুরু করেছেন। ফেসবুক পেজ, অনলাইন মার্কেট প্লেস কিংবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি অর্ডার নিচ্ছেন তারা।

ডাবের পানি এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ‘হেলদি ড্রিংক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ইতিমধ্যে ভোলার কিছু উদ্যোক্তা ডাব ও নারকেলভিত্তিক পণ্য বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে ভোলায় একটি ডাব প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব, যা দেশীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে।

ডাব চাষ পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষির উদাহরণ হতে পারে। এটি একদিকে কৃষকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে।

লালমোহন ডাব ও নারিকেল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বাজারে ডাবের অনেক চাহিদা রয়েছে। আমাদের এই জেলায় ২০০টির অধিক আড়তের আওতায় অন্তত ২৫০০ থেকে ৩০০০ হকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাব কিনে আনেন। তাদের থেকে আমরা ওইসব ডাব কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাই। বছরের ৬ মাস বাজারে ডাবের চাহিদা বেশি থাকে। তবে এই জেলা থেকে প্রতি মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে অন্তত ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার ডাব পাঠাতে পারি। এতে করে ভোলা অর্থনীতি কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

ভোলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ভোলায় প্রায় ১৮৫০ হেক্টর জমিতে ১৮ লাখ ২৭ হাজার নারিকেলগাছ রয়েছে। বছরে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন ডাব উৎপাদন করা হয়; যা বিক্রি হয় প্রায় ১১ কোটি টাকা।

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. খাইরুল ইসলাম মল্লিক বলেন, ডাব চাষ করলে কম শ্রম ও স্বল্প খরচে ভালো লাভবান হওয়া যায়। এ ছাড়া বারো মাসই ডাব বিক্রি করতে পারেন কৃষকরা। যার জন্য এরই মধ্যে উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ডাব চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কয়েকটি প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ডাব চাষ বৃদ্ধি পাবে।

স্থানীয়দের ভাষায়, ‘ডাব এখন শুধু ফল নয়; এটি ভোলার মানুষের স্বপ্ন।’ তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, মনপুরাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ডাবের বাগান এখন এক নতুন দৃশ্যপট তৈরি করেছে; যেখানে সবুজ সারির পর সারি ডাবগাছ দাঁড়িয়ে আছে সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে। ফলে ভোলার পরিচয় বদলে এখন এটি নদী, মাছ, ধান আর সুপারির পাশাপাশি পরিচিত হচ্ছে ‘ডাবের জেলা’ নামে।