ঢাকা শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫

মা-মেয়ের একক সংগ্রাম থেকে বইছে আনন্দ

বিল্লাল হোসেন, যশোর
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০২:০৪ এএম

অতি ফর্সা রঙের আফিয়া খাতুন পৃথিবীতে আসার পর মা মনিরা খাতুনের জীবনে ভর করে কষ্ট আর কষ্ট। তার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। আফিয়া অন্যের মেয়ে দাবি করে তাকে তালাকও দেওয়া হয়। আফিয়া চেনে না তার বাবাকে। পায়নি বাবার ভালোবাসা। কেউ বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে আফিয়া ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে উত্তর দেয় ‘তার বাবা বিদেশ থাকে’। স্বামী-সংসার হারিয়ে মেয়েকে নিয়ে বসবাস শুরু হয় দিনমজুর বাবার ভাঙা ঘরে। মা-মেয়ের একক সংগ্রাম থেকে এখন আনন্দ বইছে। উপহার পেয়েছে ৩ শতাংশ জমি। সেখানে নির্মাণ হবে আফিয়া ও তার মা মনিরার মাথা গোঁজার ঠাঁই পাকাঘর। এভাবে বদলে যাচ্ছে পিতৃহীন আফিয়ার জীবন। 

গত ২০২০ সালে যশোর সদর উপজেলার বাউলিয়া চাঁদপাড়া গ্রামের মোজাফফর হোসেনের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কুয়াদার বাজুয়াডাঙ্গা গ্রামের শহিদ মোল্যার মেয়ে মনিরা খাতুনের। ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর শহরের জেলরোডে অবস্থিত মাতৃসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় আফিয়ার। তার ত্বক দুধ সাদা, চুল ও ভ্রু হালকা ঘিয়ে রঙের হওয়ায় বাবা মোজাফফর মা মনিরার নামে অপপ্রচার শুরু করেন। সন্তানের অস্বীকৃতি জানিয়ে জন্মের ৮ মাস পর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মোজাফফর বিদেশ পাড়ি জমান। এরপর থেকে আফিয়াকে নিয়ে শ্রমজীবী বাবার বাড়ি চলে আসে মনিরা।

শে^তীরোগে (অ্যালবিনিজমে) আক্রান্ত আফিয়ার চিকিৎসায় সাহায্যের আবেদনে গত ৬ নভেম্বর স্থানীয় পত্রিকায় সচিত্র খবর প্রকাশ হলে বিষয়টি সংবাদকর্মী ও মানুষের নজরে আসে। এরপর আফিয়ার জীবনকাহিনি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত খবর ও ভিডিও ভাইরাল হয়। মা-মেয়ের এই কঠিন পরিস্থিতি দেখে অনেকে ব্যথিত হন।

গত ১৪ নভেম্বর সাদা রঙের কারণে পিতৃপরিচয় হারানো আফিয়ার নানা শহিদ মোল্যার বাড়িতে যান বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও যশোর-৩ সদর আসনের ধানের শীষের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে তিনি সেখানে যান। এ সময় তাদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়াসহ আফিয়ার পরিপূর্ণ লেখাপড়ার দায়িত্বের ঘোষণা দেন অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।

গত ১৮ নভেম্বর ওই শিশুর নানাবাড়িতে যান যশোর শহরের মাতৃসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মনিরুল ইসলাম ও পরিচালক (উন্নয়ন) সেলিম মোর্শেদ। তারা আফিয়ার মায়ের হাতে নগদ ২০ হাজার টাকা তুলে দেন। আর্থিক সহায়তাকালে আফিয়ার বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের ঘোষণা দেন মনিরুল ইসলাম।

১৯ নভেম্বর মানবিক সংগঠন ‘উই আর বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মানবিক পুলিশ সদস্য এস এম আকবর পৌঁছে যান আফিয়ার কাছে। তিনি নিজ হাতে আফিয়ার মায়ের হাতে ৩ শতাংশ জমির দলিল তুলে দেন। জমি কেনার পুরো ব্যয়ভার ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা বহন করেছে সংগঠনটি।

এস এম আকবর জানান, জমির দলিল উপহার দিতে গিয়ে জানতে পেরেছি জন্মের পর থেকে আফিয়াকে একবারও কোলে নেয়নি ওর বাবা, এটাই ছিল ওর মায়ের সবচেয়ে বড় কষ্ট। এখন অনেকেই আফিয়ার পাশে আছে। তাকে নিজ সন্তানের মতোই আগলে রাখতে চাই।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ওদের ঘর নেই, তাই চিন্তা করেছিলাম ওদের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিব। পরে জানলাম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘর নির্মাণ করে দেবেন। কিন্তু নিজস্ব জমি না থাকায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ওদেরই এক আত্মীয়ের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে দিয়েছি। আফিয়ার জন্য ভবিষ্যতেও আমরা কাজ করে যাব।

স্থানীয়রা জানান, আফিয়ার মায়ের সংগ্রামের গল্প শুনলে যেকোনো মানুষের হৃদয় গলে যাবে। এক অসহায় নারী মনিরা খাতুন ছোটবেলা থেকেই আর্থিক সংকট ও সমাজের নানা অবহেলার মধ্যে বড় হয়েছেন। বাবার অভাবের সংসারে বড় হয়ে গিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি। সেখানেও তার সুখ হয়নি। অতি ফর্সা মেয়ে পৃথিবীতে আসার পর সংসারটাও ভেঙে যায়। ছোট্ট আফিয়ার জীবন শুরু হয়েছিল অন্যরকম এক বাস্তবতায়। এখন অনেকে মা-মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। এখন তাদের জীবন বদলে যাবে। নিজস্ব জমি ও ঘরে বসবাস করতে পারবে।

মাতৃসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু আফিয়ার জন্ম হয়েছিল মাতৃসেবায়। গণমাধ্যমে তাদের দুর্দশার কথা জানতে পেরে অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আফিয়ার যাবতীয় চিকিৎসাসেবা বিনা মূল্যে প্রদান করা হবে।’

অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘আফিয়া জেনেটিক ডিসঅর্ডার সমস্যায় ভুগছেন। এ ধরনের সমস্যা লাখে একজনের হয়। ওর পিতার পরিবারে বা এলাকায় শিক্ষার আলো না পৌঁছানোর ফলে তারা খারাপ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারপরও আমার নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা তার পাশে আছি আগামীতেও থাকব।’

আফিয়ার মা মনিরা খাতুন বলেন, ‘তার করুণ জীবনচিত্র প্রকাশের পর মানুষের অন্তরে দাগ কেটেছে। অনেকেই তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভিন্ন রঙের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়িতে বসবাস করতে পারবেন, এটা তার জন্য অনেক খুশির খবর। জেলা প্রশাসনও আইনি ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে এগিয়ে এসেছে। দেশবাসীর কাছে তিনি আফিয়ার জন্য দোয়া চেয়েছেন। সেই সঙ্গে আফিয়ার বাবা মোজাফফর হোসেনের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবি করেছেন।’

আফিয়ার নানা শহিদ মোল্যা জানান, ‘ওরা মা-মেয়ে (আফিয়া-মনিরা) ভালো থাকলেই আমার ভালোলাগা। তারা অনেক কষ্টে দিন পার করেছে। অনেক অবহেলা ও বঞ্চিত হয়েছে। মানুষের ভালোবাসায় সেই কষ্ট দূর হতে চলেছে। আগামীতে নিশ্চয় ভালো কিছু হবে।