ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ভয়াবহ বিস্তার আজ দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোরতা, বৈদেশিক অডিট ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে শ্রেণিকরণ চালুর ফলে বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা সমস্যা এখন পূর্ণরূপে দৃশ্যমান। কিন্তু দৃশ্যমান হওয়া সমস্যাই শেষ কথা নয়। এখন সময় লাগাম টানার, তা না হলে ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায়। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩৫ শতাংশেরও বেশি। ২০০০ সালের পর এটি সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ। বাস্তবে সংকটাপন্ন সম্পদ মিলিয়ে এই অঙ্ক ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এত বড় আর্থিক ঝুঁকি কোনো অবস্থাতেই স্বাভাবিক বলা যায় না। বিগত দীর্ঘ সময়ে পুনঃতফসিল, নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট, ভুয়া হিসাব ও রাজনৈতিক প্রভাব এসবের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যে অনৈতিক চর্চা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারই মাশুল এখন দেশকে শোধ দিতে হচ্ছে।
অতীতের সরকারগুলো বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল ও নিয়মিত দেখানোর যে অসংযত সুযোগ দিয়ে এসেছে, তা ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। অনেকে ঋণ ফেরত না দিয়েও নিয়মিত গ্রাহকের সুবিধা ভোগ করেছে; আবার অনেক ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবশালী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই নীতিগত শিথিলতাই খেলাপি ঋণের বর্তমান বিস্ফোরণের প্রধান কারণ।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ঋণ পরিশোধের পরদিন থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে লভ্যাংশ নিষিদ্ধ করা, মাত্র দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি নিয়মিত করার সীমিত সুযোগসহ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তবে কেবল নীতিনির্ধারণ নয়, তার বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও কঠোরতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে জরুরি। কারণ বহু বছর ধরে বাস্তবায়নই ছিল দুর্বলতম জায়গা।
মোটাদাগে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা কেবল আর্থিক নয়। নৈতিক সংকটও বটে। সাধারণ আমানতকারীর অর্থ ঝুঁকিতে ফেলে কিছু ইচ্ছাকৃত খেলাপি দীর্ঘদিন ধরে দায় এড়িয়েছে। এখন সময় এসেছে এ ধরনের ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। একইসঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি প্রভিশন রাখতে হবে, ফলে তাদের মুনাফা কমবে, মূলধন দুর্বল হবে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধাক্কা দেবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন একটি কঠিন কিন্তু অপরিহার্য পথ হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা। আর এটি রকরতে হলে কড়া নজরদারি, স্বচ্ছ অডিট, প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের জন্য নীতিসহায়তা এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য কঠোর শাস্তিই ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই। এসব উদ্যোগই পারে এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে।
ব্যাংকিং খাতকে বলা হয় অর্থনীতির প্রাণ। তাই দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে খেলাপি ঋণের লাগাম এখনই টানতে হবে, আপসহীন, দৃঢ় এবং নিঃশর্তভাবে।

