বাংলাদেশে গাভীর দুধ উৎপাদন খাতটি দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও উন্নত জাতের গাভী পালন করা দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য একটি কার্যকর উপায়, তবে শুধু ভালো জাত নির্বাচন করলেই চলবে না। গাভীর দুধ উৎপাদন কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক, পরিবেশগত এবং ব্যবস্থাপনাগত উপাদানের উপর নির্ভর করে। যেমন- গাভীর আকার ও বংশগত বৈশিষ্ট্য, পুষ্টি সরবরাহের মান, বাসস্থানের পরিবেশ, দুধ দোহনের নিয়মিততা এবং পদ্ধতি। গাভীর বয়স ও স্বাস্থ্য অনুযায়ী দুধ উৎপাদন বাড়ানোর নির্দিষ্ট কৌশল সম্পর্কে জানাচ্ছেন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার কৃত্রিম প্রজনন কর্মী ও লাইভস্টক অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. মাসুম রেজা।
উন্নত জাতের গাভী নির্বাচন করুন
গাভীর দুধ উৎপাদন অনেকাংশেই নির্ভর করে তার জাতের উপর। সাধারণত বিদেশি জাতের গাভী যেমন- হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান বা জার্সি গরু থেকে বেশি দুধ পাওয়া যায়। যদি দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম উন্নত জাতের গাভী নির্বাচন করা যায়, তাহলে দুধ উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। তবে দেশীয় জাতের গাভীকেও উন্নত জাতের সঙ্গে ক্রস-ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে দুধ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত করা সম্ভব। উন্নত জাতের গাভী দৈনিক ১৫-৩০ লিটার দুধ দিতে সক্ষম, বিদেশি জাতের গাভী দ্র”ত বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং তুলনামূলকভাবে বেশি প্রজনন ক্ষমতা রাখে।
সুষম এবং পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ
গাভীর দুধ উৎপাদন সরাসরি তার খাদ্যাভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। গাভীকে সুষম খাদ্য দিতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, এবং ভিটামিন থাকে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান বলতে প্রোটিন থাকবে খাদ্যে ১৫-১৮ শতাংশ, এটি দুধ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস সরবরাহ করতে হবে, যা গাভীর হজমশক্তি বজায় রাখে। গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ খাদ্য ‘ডেয়ারি কনসেনট্রেট ফিড’ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-
গর্ভবতী গাভীর জন্য বাড়তি পুষ্টিকর খাবার যেমন ভুট্টার দানা, গমের ভুসি, তিলের খৈল বা সরিষার খৈল সরবরাহ করা দরকার।
পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ
গাভীর দুধের প্রায় ৮৭ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি, তাই পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০-১০০ লিটার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে গরুর পানি হজম প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখে, দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, গাভীর দেহে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ড্রাই পিরিয়ড বজায় রাখা
ড্রাই পিরিয়ড হলো গাভীর এমন একটি বিশ্রামের সময়, যখন দুধ দোহন বন্ধ থাকে। এই সময় গাভী নিজেকে শারীরিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করে এবং পরবর্তী প্রজননের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। এর সময় সাধারণত ৫০-৬০ দিন ড্রাই পিরিয়ড রাখা হয়। ড্রাই পিরিয়ডের উপকারিতা হলো গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, দুধ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে, পরবর্তী বাছুর জন্মের পর গাভী বেশি দুধ দেয়।
বাছুর প্রসবের সময় বিশেষ যতœ নিন
গর্ভবতী গাভীকে বিশেষ যতœ নিতে হবে। প্রসবের আগে এবং পরে গাভীকে বিশেষভাবে পুষ্টিকর খাবার এবং পরিচর্যা দিতে হবে। এই সময় গাভীর জন্য নরম বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে, গাভীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে, গরম পানি ও ভিটামিন সরবরাহ করা; এর ফলে গাভীর দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও প্রসবের সময় জটিলতা কমায়।
দুধ দোহনের সঠিক নিয়ম বজায় রাখা
দুধ দোহন করার নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন একই সময়ে দুধ দোহন করলে দুধ উৎপাদন স্থির থাকে। এ ক্ষেত্রে দিনে ২ বার দুধ দোহন (সকাল ও বিকেল) করা যেতে পারে, দুধ দোহনের সময় গাভীকে শান্ত রাখা, দোহনের সময় প্রতিবার গাভীর স্তন পরিষ্কার করা। এর ফলে গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, দুধের গুণগত মান বজায় থাকে।
গাভীর বাসস্থান পরিষ্কার ও আরামদায়ক রাখা
গাভীর বাসস্থান পরিচ্ছন্ন এবং আরামদায়ক রাখতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল, আলোকসজ্জা এবং শুষ্ক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তাই প্রতিদিন গাভীর ঘর পরিষ্কার করা। সপ্তাহে অন্তত ২ বার ব্লিচিং পাউডার দিয়ে মেঝে ধোয়া। গরমকালে নিয়মিত গোসল করানো এবং শীতকালে ব্রাশ দিয়ে লোম পরিষ্কার করা। এর ফলে গাভীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
শান্ত ও আরামদায়ক পরিবেশ বজায় রাখা
দুধ দোহনের সময় গাভীকে শান্ত রাখতে হবে। কোনো উচ্চ শব্দ, কুকুরের ডাক, বা অন্যান্য উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি গাভীর দুধ উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর জন্য দোহনের সময় গাভীকে আরামদায়ক রাখতে হবে। পরিবেশে অতিরিক্ত আওয়াজ কমাতে হবে।
গাভীর ব্যায়াম এবং চলাফেরার সুযোগ রাখা
গাভীকে প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট হাঁটানো উচিত। এতে করে গাভীর রক্তচলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং শরীর সুস্থ থাকে। এর ফলে গাভীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। হরমোনের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকে। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ভিটামিন এবং মিনারেল প্রিমিক্স সরবরাহ
বর্তমানে বাজারে গাভীর জন্য বিশেষ প্রিমিক্স পাওয়া যায়, যা দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর। এই প্রিমিক্সে ভিটামিন ডি, বি এবং মিনারেল সমৃদ্ধ পাউডার খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে সরবরাহ করা। এর ফলে গাভীর পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হয়। গর্ভবতী গাভীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। দুধের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
গাভীর দুধ উৎপাদন বাড়াতে হলে এই কার্যকর কৌশল সঠিকভাবে অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের গাভী পালন, পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, যথাযথ পরিচর্যা এবং সঠিক দুধ দোহন পদ্ধতি অনুসরণ করলে দুধ উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এটি কেবল গাভীর স্বাস্থ্য রক্ষা করবে না বরং দেশের দুধের চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন