২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এক পর্যায়ে পরিণত হয়েছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলেনে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রমিক, সাংবাদিকসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ একজোট হয়ে নেমে এসেছিল রাস্তায়। আন্দোলনে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতার মৃত্যু হয়। আহত হন অসংখ্য। অবশেষে দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলনে পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা আওয়ামী শাসনের সমাপ্তি ঘটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
তবে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-জনতা প্রায় এক বছরে তা কতটুকু পূরণ করতে পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার- এসব নিয়ে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রব্বানী।
রূপালী বাংলাদেশ: জনগণ কী স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল এবং সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণে হয়েছে?
উত্তর: আমরা দেখতে পাচ্ছি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী জুলাই যোদ্ধাসহ যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। সুবিধাবাদি কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে নতুন রূপে। যে মহান লক্ষ্য নিয়ে অভ্যুত্থান হয়েছিল সেখান থেকে সরে গিয়ে দেশে একটি কিংস পার্টি গঠিত হয়েছে, যারা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে সরে নিজেদের বৃহৎ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল জনগণ তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের বিতর্কে। গত ১৫ বছর ধরে যেসব রাজনৈতিক দল নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তারাও আজ নানা কুকর্মে জড়িয়ে পড়েছে।
তবে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে স্বপ্ন নিয়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাস্তায় নেমেছিলাম, যাদের জন্য কেঁদেছিলাম, যাদের নিরাপত্তা এবং বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলেছিলাম তারাই আজ বিচার ভঙ্গে জড়িত। দলমত নির্বিশেষে যে লক্ষ্য নিয়ে দেশের মানুষ আন্দোলন করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে গত এক বছরে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বস্তি ফিরে পাওয়ার আশা করেছিল। কিন্তু ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ কতটা আন্তরিক এ বিষয়ে? এই পরিষদে কতজন উপদেষ্টা আছেন যারা জুলাই আন্দোলনে নির্যাতিত? তারা কতজন আন্দোলনে সরাসরি জড়িত ছিলেন? একটি নির্দিষ্ট কোটা থেকে মানুষগুলো সরকারে এসেছেন, যারা ক্ষমতা গ্রহণের পর জনগণের স্বস্তির থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে তৎপর, যা দেশের মানুষের জন্য খুবই হতাশাজনক।
শাসকের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, চেহারা রয়েছে একই। যারাই ক্ষমতার কাছে গিয়েছে তারায় শাসক হয়ে উঠেছে। আমি মনে করি গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বেহাত হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: কোটা কি আবারও ফিরে এসেছে?
উত্তর: যে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আবারও ভর্তিসহ বিভিন্ন স্থানে তা বহাল হয়েছে। বিশেষ সুবিধা কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গেজেটভুক্ত শহিদ এবং তালিকাভুক্ত আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। তবে সেই কোটাই ভিন্নভাবে ফিরে এলো! এমনিভাবে সব বিষয়ে পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
রূপালী বাংলাদেশ: জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণ না হওয়াকে কাদের দায়ী করছেন
উত্তর: ১৯৭১ সালে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার সব অর্জন একটি দল ও একক ব্যক্তির নামে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। তেমনিভাবে ২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানও শুধু একটি দল (এনসিপি) এবং তিন-চারজনের নামে কুক্ষিগত করা হচ্ছে। যে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলন সেই বৈষম্য সবখানে লক্ষণীয়। চেয়ার আর চেহারার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র!
অনেক উপদেষ্টাকে দেখতে পাই আগের শাসক গোষ্ঠীর মতোই নিজ-স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার করতে। স্বৈরাচার সময়ের ছাত্রনেতাদের মতো নতুন দলের নেতাদের প্রটোকল-গাড়িবহর নিয়ে শক্তি প্রদর্শন চলমান। মতের অমিল হলেই চলছে মব সৃষ্টি। বিচারবহির্ভূত হামলা-মামলা, এর জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি। মানুষের নিরাপত্তা আজ বিঘ্নিত। গত এক বছরে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে সঠিকভাবে ফাংশন করাতে পারেনি, যা অবশ্যই তাদের ব্যর্থতা।
রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই আন্দোলনের পর শিক্ষকরা কী পেলো?
উত্তর: জুলাই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরাসরি অংশগ্রহণে বেগবান হয়। অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন ছিল সরাসরি আন্দোলনের সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রাখা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করা। যে শিক্ষকরা চাকরি ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল, তারা নতুন বাংলাদেশে সম্মান পায়নি, এটা লজ্জাজনক। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। তবে, দেশের যে পরিবর্তন আশা করেছিলাম তা কোনোটাই হয়নি।
প্রত্যেকটি সেক্টরে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সংস্কার কমিশন করেছে। তবে, শিক্ষা কমিশন নেই! একটি দেশের শিক্ষার সংস্কার বাদ দিয়ে উন্নয়ন আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। দেশে বর্তমানে আরও ভয়াবহ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সচিবালয়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেই ফ্যাসিস্ট সময়ের আমলারা বহাল। যাদের নিয়ে কমিশন করা হয়েছে তাদের অনেকেই বিতর্কিত। দলের প্রত্যেকে তার নিজের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যস্ত।
রূপালী বাংলাদেশ: একক ব্যক্তির ট্যাক্স মওকুফ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়হীনতা কী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্নীতির পথে ঠেলে দিচ্ছে?
উত্তর: হাজার প্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থানের পর গুরুত্ব পায় একক ব্যক্তির ট্যাক্স মওকুফের বিষয়। অন্যদিকে দেশের সাধারণ জনগণের ওপর ট্যাক্স বাড়ানো হয়! এই সরকারের জন্য নিশ্চয় মানুষ আন্দোলন করেনি। দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো ক্র্যাডিবিলিটি আছে বলে মনে করি না। তাদের দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরে যাওয়া মঙ্গলকর।
যারা জুলাইয়ের অগ্রভাগের যোদ্ধাদের বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন করে তারা নিশ্চয় ভালো মনের নয়। দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণি-চরিত্র সবসময় প্রায় একইরকমের হয়ে থাকে। সেটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হোক কিংবা অগণতান্ত্রিক সরকার হোক, তাতে শ্রেণিচরিত্রের খুব একটা পার্থক্য থাকে না। এর প্রধান কারণ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। অনেক সময় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা শাসকশ্রেণিকে নিরঙ্কুশভাবে স্বৈরাচারী করে তোলে। একইভাবে তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বলয়ে থেকে নিরঙ্কুশ দুর্নীতিগ্রস্তও হয়ে ওঠে, যা আবারও দেখা যাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :