ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পর গতকাল চতুর্থ দিনেও উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকসহ তিনটি গেট সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রধান ফটক দিয়ে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কিছু শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোনো কোনো অভিভাবককে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তাদেরও ঢুকতে হচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে আইডি কার্ড দেখিয়ে। তবে তারা গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। স্কুলটির ভেতরে ও দিয়াবাড়ি আর্মি ক্যাম্পসংলগ্ন গোলচত্বরে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে।
দু-একজন শিক্ষার্থীকে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায়। তাদের গলায় ছিল স্কুলের আইডি কার্ড। তবে শোক কাটার আগেই স্কুল খোলার সিদ্ধান্তে অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে।
একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানান, আমরা তো এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরই মধ্যে রোববার থেকে আংশিকভাবে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত মোটেও কাম্য নয়।
তবে ঘটনাস্থলে কথা হয় একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে। তারা জানান, মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রবেশের যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, এটার কারণ হতে পারে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়া। যেটা বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর, স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছে, সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে তারা হয়তো প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। তাদের দাবি, অবিলম্বে সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে চান তারা।
গতকাল সরেজমিনে সকাল ১০টায় স্কুলটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফটক বন্ধ। গত কয়েকদিনের মতো গণমাধ্যমকর্মীরা বাইরে অপেক্ষা করছেন। প্রধান ফটকের ডান দিকে সরু গলি। এ গলির মাঝখানে ও শেষে স্কুলের দুটি গেটÑ এ দুটি গেটও বন্ধ। গলিটিতে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। সকালের বৃষ্টিতে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ও গলিতে পানি জমেছে। কাদাপানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন এলাকাবাসী। প্রধান ফটকের বাইরে কয়েকজনকে ছবি তুলতে ও ভিডিও ধারণ করতে দেখা গেছে। সকাল থেকে দিয়াবাড়ি মোড় ও আশপাশের এলাকায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা গেছে।
নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, কর্মকর্তাদের নির্দেশে স্কুলের গেটগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। অভিভাবক, শিক্ষক ও কর্মচারীরা আইডি কার্ড দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারবে। প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় শাহেদুল নামের একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা কাছেই। এখানে এমনিতেই এসেছি। এত বড় একটি দুর্ঘটনা হয়ে গেল, নিহতদের স্মরণে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ হলে খুব ভালো হতো।’
এখনো নিখোঁজ ৩ শিক্ষার্থী, ২ অভিভাবক
এদিকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার দিন উপস্থিত থাকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই হতাহতদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার তিন দিন পরও তিনজন ছাত্রী ও দুইজন অভিভাবকের সন্ধান মেলেনি। ওই ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানটির স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আসা তথ্যমতে এখনো পাঁচজন নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের তিনজন শিক্ষার্থী এবং দুইজন অভিভাবক। এ তথ্য পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে।’
আংশিক চালু হবে পাঠদান কার্যক্রম, শিক্ষার্থী-অভিভাবক-এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ
উত্তরার দিয়াবাড়িতে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার পর বন্ধ থাকা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সীমিত আকারে পাঠদান কার্যক্রম পুনরায় চালু হচ্ছে। আগামী রোববার থেকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য শ্রেণির কার্যক্রম ধাপে ধাপে চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
গত বুধবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বস্তি এবং একাডেমিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা ধীরে ধীরে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এদিকে আগামী রোববার থেকে প্রতিষ্ঠানটির নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হবে এমন তথ্যের পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থী আবু হেনা জানান, আমরা তো গভীরভাবে শোকাহত। এখন কি আমাদের লেখাপড়ার মতো পরিবেশ আছে। অভিভাবক লায়লা বেগম বলেন, স্কুল বা কলেজ খুললেও আমার বাচ্চা ভয় পাওয়ায় আপাতত পাঠাব না। এলাকায় বসবাসরত ফারুক মিয়া জানান, বিকট শব্দে ভয়ে এখনো ঘুমাতে পারি না। বাচ্চারা এত সহজে স্কুল-কলেজে ক্লাস করবে কী করে? মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষকদের কি এটা বোঝার সক্ষমতা নেই।
স্কুলে জেট ফুয়েলের গন্ধ, ছড়ানো স্কুলব্যাগ-টিফিনবক্স
বিধ্বস্ত মাইলস্টোনের স্কুলের বাতাসে এখনো ভাসছে জেট ফুয়েল ও পোড়া ভবনের গন্ধ। এ ছাড়া বিধ্বস্ত ও পোড়া স্কুল ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট্ট শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ ও বইখাতা। এমনকি, পড়ে আছে খাবারসহ টিফিনের বাটিও। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধ্বংসপ্রাপ্ত হায়দার আলী ভবনে সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। গত ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রীদের দিগি¦দিক ছোটাছুটি ও আর্তনাদ। এমনকি পোড়া শরীর নিয়েও ছুটতে থাকে শিক্ষার্থীরা। অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের কেউ কেউ ঘরে ফেরেন বেঁচে যাওয়া সুস্থ সন্তান নিয়ে, কেউ আবার সন্তানের লাশ নিয়ে, কেউবা ছুটে যান হাসপাতালে। হৃদয়বিদারক এই ঘটনায় অভিভাবক ছাড়াও সাধারণ মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে রাজধানীর বাতাস।
মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডিরেক্টর কাজী বিলকিস আরা আইরিন বলেন, ‘বিমান দুর্ঘটনায় বাচ্চারা মারা গেছে, এটি আমি মেনে নিতে পারছি না। ছোট ছোট সব ছেলেমেয়ে, বয়সই বা কত হয়েছিল। জীবন সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের প্রাণ কেড়ে নিল। আর মৃত্যুর সংখ্যা বেশিÑ এ রকম অভিযোগ সঠিক নয়। এই সংখ্যা তো গোপন করার কিছু নেই। শিক্ষার্থীদের তো উপস্থিতির খাতা আছে। সেগুলো আমরা লুকাব কীভাবে। যদি কেউ এখন পর্যন্ত সন্তানকে খুঁজে না পেতেন তাহলে তো আমাদের কাছে ছুটে আসতেন। আমরা তো সে রকম কিছু দেখছি না।’
তারেক রহমানের নির্দেশে দগ্ধদের পাশে ছাত্রদল
মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তে দগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন। তিনি বলেন, মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তে দগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের সরকার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করছি। তা ছাড়া এসব বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সব সময় আমাদের কাছে খোঁজখবর নিচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা সামগ্রী দেওয়ার আগে তিনি এ কথা বলেন।
ছাত্রদল নেতা বলেন, মাইলস্টোনে দুর্ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। মাইলস্টোনে নিহতের সংখ্যা নিয়ে জামায়াতের আমির দায়িত্বশীল জায়গায় থেকেও ভুল বক্তব্য দিয়েছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন