বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাদের লেনদেন, অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৩ আগস্ট) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে ব্যাংকগুলোকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চাওয়ার তালিকায় রয়েছেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আতিউর রহমান বিদেশে চলে যান। আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় গত বছরের ৭ আগস্ট ই-মেইলযোগে পদত্যাগ করেন। তালিকায় থাকা ছয় ডেপুটি গভর্নরের মধ্যে গত সরকার পতনের পর দুদকের মামলায় জেলে থাকা এস কে সুর চৌধুরী এবং বিএফআইইউর প্রধান থেকে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া মো. মাসুদ বিশ্বাস রয়েছেন। আরও আছেন মাসুদ বিশ্বাসের আগে দীর্ঘদিন বিএফআইইউর প্রধানের পদে থাকা আবু হেনা মো. রাজী হাসান, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছের।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রত্যেকের অ্যাকাউন্ট খোলার ফরম, লেনদেন, কেওয়াইসিসহ যাবতীয় তথ্য তিন কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে হবে। কোনো অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে থাকলে সেই তথ্যও জানাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন একজন অধ্যাপক ও দুজন আমলা। এই সাড়ে ১৫ বছরে তাদের নেতৃত্বেই ব্যাংক খাত ধ্বংস করা হয়। এর মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে ছিল দুর্বলতা। এই সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। আবার তার সময়েই ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আতিউর রহমানের সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। রিজার্ভ চুরির বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন আতিউর। এ ঘটনার পরই তিনি পদত্যাগ করেন।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির। তার মাধ্যমেই ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপ। গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। এরপর এসব ব্যাংকে লুটপাট শুরু হলে তিনি তদারকি কমিয়ে দেন। এ ছাড়া ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করা, সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রাখা এবং নামমাত্র টাকা দিয়ে খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার পদ্ধতি চালু হয় তার আমলে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী এসব টাকা বিদেশে পাচার করেন।
ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষে আরেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হন। যত বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল, দুই বছরের মাথায় সব নিয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। তার আমলেও আগের মতো বেনামে ঋণ ও জালিয়াতি করে ঋণ বিতরণের ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। পরে অনিয়মে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে পড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এসেই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। আবার তার সময়েই এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব টাকাও ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক এই তিন গভর্নর। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে যান আতিউর। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তার পাসপোর্ট ব্লক করেছে সরকার। ফজলে কবির দেশেই রয়েছেন, তবে হাসিনার পতনের পর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুর রউফ। তিনিও দেশে আছেন বলে জানা গেছে।
ব্যাংক হিসাব তলব করা সাবেক ছয় ডেপুটি গভর্নর হলেনÑ সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এস কে সুর), মাসুদ বিশ্বাস, এস এম মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান, কাজী ছাইদুর রহমান এবং আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের। এদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বর্তমানে দুদকের মামলায় জেলহাজতে আছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অর্থ পাচার প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকলেও বিএফআইইউর প্রধান হিসেবে মাসুদ বিশ্বাস কোনো পদক্ষেপ নেননি। উল্টো পাচারকারীদের সহায়তায় নিজের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান দায়িত্ব পেয়ে ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন বন্ধ করে দেন। বিএফআইইউর সাবেক প্রধান রাজী হাসানের সময়ে অর্থ পাচার হলেও তিনি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অভিযোগ রয়েছে, ডলারের বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কাজী ছাইদুর রহমান। ২০২১ সালে ডিজি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আবু ফরাহ মো. নাছের ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি। এ জন্য মেয়াদ শেষে তাকেও ব্যাংকিং নীতি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।