গ্রামীণ জীবনে হাঁস পালন একটি পরিচিত আয়ের পথ। কম খরচে, কম পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে ভালো লাভ পাওয়া যায় বলে বাংলাদেশে হাঁস পালনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। দেশের নানা অঞ্চলে, বিশেষ করে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাঁস পালন করে অনেক মানুষ সচ্ছল জীবন ফিরে পেয়েছেন। যে এলাকাগুলোতে খাল-বিল, নদী বা পুকুর আছে, সেখানে হাঁস পালন সহজ এবং লাভজনক। ফলে হাঁস এখন গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার একটি বড় উপায় হয়ে উঠেছে।
হাঁস পালনের সুবিধা
মুরগির তুলনায় হাঁস পালনে কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। হাঁস সাধারণত রোগবালাইয়ে কম আক্রান্ত হয়, ফলে চিকিৎসা খরচও কম পড়ে। এ ছাড়া মুরগির তুলনায় হাঁস অনেক সহজেই প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। গ্রামের পুকুর, ধানখেত বা জলাশয়ে হাঁস ছেড়ে দিলে তারা নিজেরাই খাবারের বড় অংশ জোগাড় করে নেয়। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে ছোট পোকা, ঘাস-লতাপাতা, শামুক বা জলজ উদ্ভিদ। ফলে খাবারের খরচও তুলনামূলক কম হয়। আরেকটি বড় সুবিধা হলো, হাঁস সাধারণত দলে দলে চলে। একবার যদি সঠিকভাবে হাঁসের খামার শুরু করা যায়, তবে খুব দ্রুতই ডিম উৎপাদন শুরু হয়। দেশি জাতের হাঁস বছরে প্রায় ১৫০-১৮০টি ডিম দেয়। আবার দেশি-বিদেশি ক্রস বা উন্নত জাতের হাঁস যেমন, খাকি ক্যাম্ববেল ও ইন্ডিয়ান রানার বছরে প্রায় ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দেয়; যার ফলে আয় বাড়ে প্রায় দ্বিগুণ। হাঁসের ডিম পুষ্টিগুণে ভরপুর। হাঁসের ডিমের বাজার চাহিদা সবসময় স্থিতিশীল থাকে, ফলে নিয়মিত আয় করা যায়।
হাঁস পালনের উপযোগী পরিবেশ
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান হাঁস পালনের জন্য আদর্শ। গ্রামীণ পরিবেশে প্রচুর জলাশয়, খাল-বিল, পুকুর থাকায় হাঁসের জন্য প্রাকৃতিক খাবার পাওয়া সহজ হয়। বর্ষাকাল এবং পরের মাসগুলোতে যখন চারপাশ পানিতে ভরে যায়, তখন হাঁস পালনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে হাঁস প্রচুর খাবার পায় এবং ডিম উৎপাদনও বেড়ে যায়। শীতকালে খামারে একটু বাড়তি যতœ নিতে হয়। ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। তবে সারা বছরই হাঁস পালন করা সম্ভব, যদি সঠিকভাবে খামার ব্যবস্থাপনা করা যায়।
অর্থনৈতিক দিক
বাংলাদেশে হাঁস পালন অনেককে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে। একজন খামারি যদি প্রাথমিকভাবে ২০০-৫০০টি হাঁস পালন শুরু করেন, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া সম্ভব। ডিম ছাড়াও বাজারে হাঁসের মাংসেরও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে উৎসব বা শীতকালে হাঁসের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে, তখন দামও বাড়ে। একটি হাঁস সাধারণত ৬-৭ মাস বয়সে ডিম দিতে শুরু করে। প্রতিদিন একেকটি হাঁস ডিম দিলে সহজেই মাসিক ভালো আয় করা যায়। এ থেকে খাবার ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়েও লাভজনক থাকা যায়।
হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ
মাছ চাষের সঙ্গে হাঁস পালন করলে দ্বিগুণ লাভ পাওয়া যায়। হাঁসকে বলা হয় পুকুরের প্রাকৃতিক জৈবসার উৎপাদনকারী মেশিন। একেকটি হাঁস মাসে প্রায় ২-৩ কেজি জৈবসার পানিতে ছড়িয়ে দেয়। এ সার মাছের খাবার হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৩-৪টি হাঁসের জৈবসার থেকে ১ কেজি অতিরিক্ত মাছ উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া হাঁস পুকুরের আগাছা, পোকা-মাকড়, শামুক ও ব্যাংগাচি খেয়ে ফেলে; যা মাছের কোনো কাজে আসে না। ফলে পানি পরিষ্কার থাকে এবং মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। একসঙ্গে মাছ ও হাঁসের
চাষ করলে বছরে প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০-১৫ টন পর্যন্ত অতিরিক্ত উৎপাদন সম্ভব। এই পদ্ধতি শুধু বাংলাদেশ নয়, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান ও হংকং-এর মতো উন্নত দেশেও ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে।
হাঁসের ঘর ও ব্যবস্থাপনা
হাঁসের ঘর সাধারণত পুকুরের পাশে বা উপরেই বানানো হয়। যদি ঘর সরাসরি পুকুরের ওপর নির্মাণ করা হয়, তবে হাঁসের মল ও উচ্ছিষ্ট খাবার পানিতে পড়ে মাছের খাবার হিসেবে কাজে আসে। আবার পুকুরপাড়ে হাঁসের ঘর করলে ড্রেনের মাধ্যমে বর্জ্য পানিতে দেওয়া যায়। এতে মাছের চাষও লাভজনক হয়। পরিচ্ছন্নতা ও বাসস্থানের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল, খাবার ও পানির ব্যবস্থা, নিয়মিত টিকা প্রয়োগ এবং ডিম সংগ্রহে যতœবান হলে হাঁস পালন অনেক সহজ হয়ে যায়।
হাঁসের জাত
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের হাঁস পাওয়া যায়। দেশি হাঁস, খাকি ক্যাম্পবেল, ইন্ডিয়ান রানার, পেকিংসহ অনেক জাত এখানে পালন করা হচ্ছে। খাকি ক্যাম্পবেল ও ইন্ডিয়ান রানার জাতের হাঁস ডিম উৎপাদনে এগিয়ে, আবার পেকিং জাত মাংস উৎপাদনের জন্য জনপ্রিয়।
হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হাঁসের বাচ্চা সহজেই পাওয়া যায়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা, নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার কেন্দ্রীয় হাঁস খামার, খুলনার দৌলতপুর হাঁস খামারসহ অনেক জায়গা থেকে মানসম্মত হাঁসের বাচ্চা সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়া অনেক খামারি নিজেই ইনকিউবেটর ব্যবহার করে ডিম ফোটান এবং বাচ্চা বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন।
হাঁস পালনে বেকারত্ব কমছে
বাংলাদেশের অনেক গ্রামীণ নারীও হাঁস পালন করে নিজেদের সংসারে অবদান রাখছেন। স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাড়ির আঙিনা বা পুকুরপাড়েই ছোট পরিসরে হাঁস পালন শুরু করা যায়। এতে করে নারীরা পরিবারের আর্থিক সহায়তা করছেন এবং সমাজে স্বনির্ভরতার উদাহরণ হয়ে উঠছেন। হাঁস পালন অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল করতে ভূমিকা রাখছে। যদি সঠিক পরিকল্পনা ও সরকারি সহায়তা জোরদার করা যায়, তবে হাঁস পালন দেশের বেকারত্ব কমাতে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন