সিলেট নগরীর জনপ্রিয় কাপড়ের ব্র্যান্ড শপগুলোতে চলছে ‘ডিসকাউন্ট’ বন্যা। ৩০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা ঝুলছে প্রতিটি দোকানে। আকর্ষণীয় অফারের নামে প্রতিদিনই হাজারো মানুষ ভিড় করছেন এসব শোরুমে। তবে অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না, প্রকৃতপক্ষে তারা লাভ করছেন, না ঠকছেন!
সম্প্রতি নগরীর একটি শোরুমে গিয়ে দেখা যায় ১৩৯০ টাকা মূল্যের একটি পাঞ্জাবিতে ৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। ছাড়ের পর বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৯৭৩ টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পাঞ্জাবির প্রকৃত উৎপাদন খরচ কত? এত বড় ছাড় দিয়েও ব্যবসা যদি টিকে থাকে, তবে আগেই কি অতিরিক্ত লাভ করা হয়েছিল?
বাটন’র স্বত্বাধিকারী খোকন আহমদ বলেন, ‘আমরা বাজার অনুসারে মূল্য নির্ধারণ করি। পণ্যের মান, ডিজাইন ও কাঁচামালের দামের ওপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ডিসকাউন্ট দেওয়ার সময় আমরা ব্যবসার স্বার্থ বিবেচনা করি। কিছু সময় পণ্যের স্টক কমিয়ে দিতে ছাড় দিই, এতে গ্রাহকও উপকৃত হন।’
দেশের পোশাক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশির ভাগ ব্র্যান্ড শপ নিজেদের পণ্যে অস্বাভাবিক মূল্য বসিয়ে রাখে। পরে ‘ডিসকাউন্ট’ নামে সেই মূল্যের ২০-৩০ শতাংশ কমিয়ে পণ্য বিক্রি করলেও আসল দাম তার অনেক কম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের লাভ থেকেই যায়।
একটি ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি যার গায়ে মূল্য লেখা ১৩৯০ টাকা, বাজার বিশ্লেষকদের মতে এর উৎপাদন খরচ হতে পারে সর্বোচ্চ ৪০০-৫০০ টাকা। মানে ৩০ শতাংশ ছাড় দিয়েও ৪০-৫০ শতাংশ লাভ থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখনো ব্র্যান্ড পণ্যের মূল্য নির্ধারণে কিংবা ‘ছাড়’ প্রদানে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান দাম বাড়িয়ে সেটিকে ‘ছাড়’ দেখিয়ে বিক্রির সুযোগ নিচ্ছে। এতে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও ব্র্যান্ড শপগুলোর এমন কৌশলী প্রতারণা প্রায়ই নজর এড়িয়ে যায়।
নগরীর নয়াসড়কের একটি ব্র্যান্ড শপের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম জানান, ‘মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করাটা ব্যবসার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। ডিসকাউন্ট দিলে গ্রাহক আকৃষ্ট হয় এবং বিক্রি বৃদ্ধি পায়। আমাদের দোকানে সব পণ্যের দাম স্পষ্ট থাকে এবং ডিসকাউন্টের পর দামও দেখানো হয়।’
নগরীর কুমারপাড়ার একটি ব্র্যান্ড শপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেলসম্যান বলেন, ‘গ্রাহকরা সাধারণত দাম দেখে সিদ্ধান্ত নেন। আমরা ডিসকাউন্ট দিলে সবাই খুশি হয়। কেউই জানে না পণ্য আসলে কত দামে কিনে আনা হয়। ব্যবসায় কিছুটা লাভ অবশ্যই থাকবে। অনেক ক্ষেত্রেই কিছু কৌশল নেওয়া হয়। কাস্টমার তো আর জানে না পণ্য কত ক্রয় করে কত বিক্রয় করা হচ্ছে। ভেতরের খবর বললে তো চাকরি থাকবে না।’
মহানগরীর নয়াসড়কের একটি ব্র্যান্ড শপে আসা গ্রাহক রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘নগরীর ব্র্যান্ড শপগুলোতে সবসময়ই ডিসকাউন্ট মেলা চলে, অথচ দাম কমার চিহ্ন দেখি না। অনেক ব্র্যান্ড শপ দাম বাড়িয়ে ডিসকাউন্ট দিয়ে তারা গ্রাহককে ঠকাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্র্যান্ডেড পোশাক বিক্রেতাদের একতরফা লাভ নিশ্চিত করতে এই ধরনের কৌশল গ্রাহকদের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আরিফ মিয়া বলেন, “আমরা নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করি। তবে দেশের পোশাক খাতে কোনো সুনির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ বিধিমালা না থাকার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান অযথা দাম বাড়িয়ে রাখে এবং ‘ডিসকাউন্ট’ নামে বিক্রি করে। আমরা চাই, ভোক্তারা সচেতন হোন এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপ আমাদের জানাবেন। সন্দেহজনক মূল্যের পণ্য সম্পর্কে ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করুন।”
ব্র্যান্ডের মোড়কে প্রতিনিয়ত ভোক্তারা ঠকছেন ‘ছাড়’ নামক প্রতারণার জালে। এই বিষয়ে সরকারের উচিত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডিসকাউন্টের হিসাব স্বচ্ছভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা। ডিসকাউন্টের নামে অধিক লাভের কৌশল ভোক্তাদের জন্য বড় ঝুঁকি। মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে এমন অসাধু ব্যবসা বাড়ছে। ভোক্তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধে আইন প্রণয়ন জরুরি।