প্রকৃতিতে এখন বর্ষাকাল। এই ঋতু অনেকের কাছে মনোমুগ্ধকর হলেও শরীরের জন্য বয়ে আনতে পারে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশেষ করে বর্ষায় বাড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আর ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে ব্যক্তি সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে এ সময় জ্বর হলে কখনো তা নিয়ে অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ হতে পারে তা ডেঙ্গুজ্বর। শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস প্রবেশ করলে প্লাটিলেটের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে ডেঙ্গু রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তবে তার আগে দরকার রোগটি শনাক্ত করা। কীভাবে বুঝবেন কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি না-
> ডেঙ্গুর লক্ষণ কী কী?
১. প্রচ- জ্বর (১০৪ ডিগ্রি) ২. প্রচ- মাথাব্যথা ৩. চোখের পেছনে ব্যথা ৪. পেশি ও শরীরের বিভিন্ন গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা ৫. বমি বমি ভাব ৬. মাথা ঘোরা ৭. বিভিন্ন গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া ৮. শরীরে র্যাশ বের হওয়া ইত্যাদি। যাদের একবার ডেঙ্গু সেরে যাওয়ার পর আবারও ডেঙ্গু হয়, তাদের সিভিয়ার ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার নিতে পারে ডেঙ্গু। সিভিয়ার ডেঙ্গুর কিছু লক্ষণ আছে।
> সিভিয়ার ডেঙ্গুর লক্ষণ কী কী?
১. প্রচ- পেট ব্যথা ২. ঘন ঘন বমি ৩. দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করে ৪. মাড়ি থেকে রক্ত পড়া ৫. ক্লান্তি ৬. অস্থিরভাব ৭. বমির সঙ্গে রক্ত পড়া ৮. প্রচ- পানি পিপাসা ৯. ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের। আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ২৭১ জন। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর, ২০২৩ সালে, আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।
> ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ঘরোয়া পরামর্শ
মধু: প্রতিদিন সেবনে ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
কালোজিরা তেল: কালোজিরা বা কালিজিরা তেলকে বলে সব রোগের মহৌষধ! তবে প্রতিদিন ৩ চা চামচের বেশি খাওয়া ঠিক নয়! আগে কখনো না খেয়ে থাকলে আধা চামচ করে শরীরে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারেন! যেকোনো পেশেন্ট ও গর্ভবতী মহিলা সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
নিমের তেল: বাড়িতে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পানির সঙ্গে নিমের তেল মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। এ ছাড়া ১০-১৫ ফোটা নিম তেল আধা কাপ নারিকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে গায়ে লাগালেও মশারা আর ধারেকাছে ঘেঁষবে না।
নারিকেল তেল: নারিকেল তেল মাখলে মশা কাছে ঘেঁষে না।
হলুদের গুঁড়া: হলুদের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা প্রভৃতি নানা পদার্থ রয়েছে। তাই হলুদ খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে। প্রতিদিন দুধ বা পানির সঙ্গে হলুদের গুঁড়া বা রস মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করলে অনেকটাই সুস্থ থাকা সম্ভব। তবে মাত্রাতিরিক্ত সেবন করা যাবে না। রোগী, বিভিন্ন ওষুধ সেবনকারী ও গর্ভবতী মহিলারা সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
দুধ, কলা, ডিম: এগুলোকে সুষম খাদ্য বলা হয়! প্রতিদিন সেবনে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে! অনেকের এসব খাদ্যে অ্যালার্জি থাকে অথবা বিভিন্ন রোগে (যেমন: কিডনির রোগ, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স ইত্যাদিতে) দুধ নিষিদ্ধ খাদ্য।
পেঁপে ও পেঁপেপাতা: পেঁপে খুব দ্রুত রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম। মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপেপাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিদিন পেঁপেপাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস পান করুন।
ড্রাগন ফল: ড্রাগন ফলে আছে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট! এটি রক্তের শ্বেতকণিকা বাড়াতে সাহায্য করে।
মিষ্টি কুমড়া ও কুমড়া বীজ: মিষ্টি কুমড়া রক্তের প্লাটিলেট তৈরি করতে বেশ কার্যকরী। এ ছাড়াও মিষ্টি কুমড়ায় আছে ভিটামিন এ, যা প্লাটিলেট তৈরিতে সহায়তা করে।
লেবু: লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
দেশি মাছ: দেশি বিভিন্ন মাছ (যেমন- কই, শিং, মাগুর, শোল, বাইন, ছোট মাছ, পাঁচমিশালি মাছ ইত্যাদি) শরীরে রক্ত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
> করণীয় : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে উচ্চ তাপমাত্রা রোধ করতে শরীর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছে দিতে হবে। শরীর বেশি ঠান্ডা মনে হলে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে পূর্ণ বিশ্রামে রেখে বেশি করে পানি খেতে দিতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষাকাল এলেই বাড়ে ডেঙ্গুর উপদ্রব। তাই বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এ সময়ে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা ও বাতাসে অত্যধিক আর্দ্রতা এ মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, গাড়ির চাকার টায়ার, বাড়ির পানি সংগ্রহের ট্যাংক, ফুলের টব ও ফুলদানিতে জমে থাকা পানিতে এ মশা বংশ বিস্তার করে। এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে শুকনো মৌসুমে এ মশা কমে যায়। আর বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। তাই নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে ডেঙ্গু থেকে নিরাপদে রাখতে প্রয়োজন সতর্কতা। আর বর্ষাকাল যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বার্তা আনে, তেমনি রোগজীবাণুর জন্যও উপযুক্ত সময়। তবে একটু সচেতন থাকলেই নিজেকে ও পরিবারকে ডেঙ্গু রোগ থেকে সহজেই সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। এখনই সতর্ক হোন, সুস্থ থাকুন।
লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি