আমার ছেলেটা ঘুমাচ্ছে, না মরে গেছে?
এই প্রশ্ন করেছিলেন উত্তরা দিয়াবাড়ির এক মা, যিনি কোলে করে তার ছেলে মাহিরের দগ্ধ দেহটি ধরে বসে ছিলেন মাইলস্টোন স্কুলের সামনে। চোখে ছিল হতাশার গ্লানি, বুকের ভেতর কান্নার গর্জন। কিন্তু তার মাথায় হাত বুলিয়ে কে তাকে বলবে? মাহির আর এই পৃথিবীতে নেই। এ রকম শত কষ্টের কাব্য জন্ম দিয়েছে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা। চোখের পলকেই অনেকের রঙিন পৃথিবী নিকোষ কালো অন্ধকারে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সকালে স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে ফিটফাট হয়ে বের হওয়া বাচ্চাগুলো আজ বাবা-মায়ের কাছে স্মৃতি। অনেকে কাতরাচ্ছে বার্ন ইউনিটে। বাবা-মায়েরা দৌড়াচ্ছেন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে, সন্তানের খোঁজে। হাসপাতালে সন্তানের পাশে বসে বাবা মা একটু পরপরই দেখছেন, তার আদরের সন্তান নিঃশ^াস নিচ্ছে তো! কেউ বা চিকিৎসকের কাছ থেকে একটু আশার বাণী পেতে মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আহা! কী হৃদয় ভেদ করা, বুক ভারি করা কষ্টের দিন পার করছেন তারা।
২১ জুলাই দুপুরে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ধেয়ে আসে মাইলস্টোন স্কুলের দিকে। ক্লাসরুমে তখন চলছে রুটিন ক্লাস, কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী হয়তো গল্প করছিল, কেউ টিফিন খাচ্ছিল, কেউ হয়তো টেবিলের নিচে লুকিয়ে কার্টুন বই পড়ছিল। এমনই এক দুপুরে হঠাৎ করেই একটি বিস্ফোরণ, বিকট শব্দ, তারপর ধোঁয়া, আগুন, আর চারপাশে পোড়া গন্ধ আর দগ্ধ দেহ।
একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু খুব বেশি দেখেনি বাংলাদেশ। এই ক্ষত সহজে সারবে না, এই ক্ষতি কতদিনে পূরণ হবে। তা আমাদের জানা নেই। মাইলস্টোন স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। এই দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনের বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়েছে শোক।
কিন্তু বিমান দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকার সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতার যে নজির স্থাপন করেছে, সেটা এক কথায় অগ্রহণযোগ্য। এই ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা নয়, এটি এক জাতীয় ট্রমা। যারা চোখের সামনে বন্ধুকে পুড়ে যেতে দেখেছে, তারা আজীবন বয়ে বেড়াবে এই ট্র্যাজেডির ক্ষত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতবড় একটি ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা প্রথম দিন দেখা যায়নি, যা জনমনে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যে গড়িমসি করা হলো তা দেশের মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের এই অবাক করা আচরণ, শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভে গড়ায়। সচিবালয়ে বিক্ষোভের জেরে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে পোস্ট দিয়ে তা আবার সরিয়ে নেওয়া হয়। সরকারের এসব নানারকম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে জনমনে নিহতের সঠিক সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে আওয়াজ উঠছে, সরকার দুর্ঘটনায় নিহতদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করছে না।
লাশ গুম করে প্রকৃত সংখ্যা গোপনের অভিযোগ উঠেছে। কয়েক দফায় আন্দোলন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
যদিও নিহতের সংখ্যা লুকানোর অভিযোগ সরকার নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু একেক স্থান থেকে একেক রকম হিসাব আসায় তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
শুধু নিহতের ক্ষেত্রেই নয়, আহতের তথ্য নিয়েও দুই রকম তথ্য আসছে। নিখোঁজদের বিষয়ে কোনো তথ্যই দেওয়া হচ্ছে না। এসব দেখে ক্ষোভ জানাচ্ছেন অনেকে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান তথ্য বিভ্রাটের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, এই বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করছেন তারা।
সোমবারই হতাহতের তথ্যে গরমিল দেখা গিয়েছিল। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে হতাহতের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছিল, তা মিলছিল না জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক সায়েদুল ইসলামের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে।
এই অবস্থার অতিদ্রুত সমাধান প্রয়োজন। না হলে জনরোষ আরও বাড়তে থাকবে। তা ছাড়া দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত সবার পরিচয় জানার অধিকার জনগণের আছে।
ইতোমধ্যে আহত, নিহত ও নিখোঁজ শিক্ষার্থী এবং অন্যদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে ঠিকানাসহ তালিকা প্রস্তুত করতে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলমকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।
আমরা আশা করি, এই কমিটি আইএসপিআরের সঙ্গে সমন্বয় করে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির নিহতের তালিকা নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে তা অতিদ্রুত দূর করবে। সেই সঙ্গে এই মর্মান্তিক ঘটনা, এতগুলো শিশুর অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষা নেবে। কেননা সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :