শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ০১:২৬ এএম

মতামত

শিশু মত্যুর দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারেনা

মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ০১:২৬ এএম

শিশু মত্যুর দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারেনা

শৈশব গিয়েছিল স্কুলে, ফিরল কফিনে। আকাশ থেকে আগুন নেমে এলো রাজধানীর মিরপুরে। শিশুদের ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল এক যুদ্ধ বিমান। যুদ্ধ হয়নি। ছিল না কোনো শত্রু, ছিল না কোনো ঘোষণা। শুধু এক পুরোনো চীনা যুদ্ধবিমান, আর রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার ছোবল। মাইলস্টোন স্কুলের প্রাঙ্গণে যে আগুন লেগেছিল, তা শুধু ভবন নয়-ভস্ম করে দিয়েছে একটি জাতির বিবেক। পুড়ে যাওয়া বইয়ের পাতা, রক্তমাখা টিফিনবক্স আর জ্বলে যাওয়া খেলার মাঠ-এসবই এখন আমাদের শোকের চিহ্ন। কিন্তু এই শোক কেবল শোক নয়, এই শোক এক আর্তনাদ-এক জাতিগত জবাবদিহির ডাক। শিশুদের মৃত্যু হঠাৎ হয়নি। এটা এসেছে সিস্টেম নামের এক কুৎসিত দৈত্যের জিহ্বা থেকে। এখনো যদি আমরা চুপ থাকি, প্রশ্ন না তুলি-তবে পরের কফিনটা আমাদের সন্তানের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রস্তুত আছি তো?

এই লেখা তাদের জন্য, যারা বই হাতে এসেছিল ভবিষ্যৎ গড়তে, আর ফিরল কফিনে। এই কলাম সেই মায়েদের জন্য, যারা শেষবার ছেলের টিফিন বক্সে আদর রেখেছিলেন-জানতেন না সেটা হবে শেষ প্রার্থনা। এই মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এ এক রাষ্ট্রীয় বিশ্বাসঘাতকতা। চুপ করে থাকলে কেবল ইতিহাসের পাতায় রক্তের ছাপ পড়ে, কিন্তু প্রতিবাদে গড়ে ওঠে বিবেকের ফাটল। প্রশ্ন তাই রেখেই শুরু করি-শিশুর রক্তে ভেজা স্কুলঘরে কে দেবে জবাব? যে রাষ্ট্র তার শিশুদের স্কুলে নিরাপত্তা দিতে পারে না, যে রাষ্ট্র শিশুর চোখের জল পর্যন্ত দেখতে পায় না-সে   রাষ্ট্রকে আর কতদিন সহ্য করব আমরা? প্রতিটি শিশু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ, কিন্তু যখন সেই ভবিষ্যৎ ভস্ম হয়ে যায়, তখন শুধু চোখের জল নয়, দরকার হয়ে পড়ে এক সামাজিক জাগরণ। শিশুরা প্রশ্ন তুলতে পারে না, তাদের হয়ে কথা বলা আমাদের দায়িত্ব। এই কলাম সেই দায় থেকেই রচিত। এই লেখার প্রতিটি শব্দ সেই পোড়া কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, যে কণ্ঠ আর কোনোদিন আকাশে গান গাইবে না। এখনই না জাগলে, না প্রতিরোধ গড়লে, আগামীকাল হয়তো শিরোনামে থাকবে আমাদেরই সন্তানদের নাম।
 

চীনা যুদ্ধবিমান ‘এফ-৭’ যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির। তিনি মারা যাননি আকাশে। এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা হত্যা। তিনি মরে গিয়েছিলেন সেই দিন, যেদিন কোটি কোটি বাজেট চুরি হয়েছিল। ৪৮ বছরের পুরোনো ‘এফ-৭’ দিয়ে ট্রেনিং! দুর্নীতির প্রতীক সেই জংধরা প্লেনই ছিল তার কফিন। সিস্টেম তাকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি। আজ শুধু একজন পাইলট নয়, নিচে থাকা শিক্ষার্থীরাও প্রাণ হারিয়েছে। এই মৃত্যু নয়, এটা ব্যর্থতা।

এটা দুর্নীতি। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। এই মৃত্যুর দায় আমাদের সবার। এখনো যদি আমরা না জাগি, না প্রশ্ন করি, না প্রতিরোধ গড়ি- তবে আমরা আর মানুষ নই, আমরা ইতিহাসের নিষ্ঠুর পাঠ মাত্র। আজ যারা নিথর, কাল তাদের জায়গায় হয়তো আমাদের সন্তান। তাই, চোখের জল যথেষ্ট নয়- প্রতিবাদই হবে প্রকৃত শোক। কিন্তু এই শোককে আমরা কেবল আবেগে মুড়ে রাখতে পারি না। এই মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়- এটা রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা, নিরাপত্তাহীনতা ও চিরচেনা ‘চলে যাবে’ সংস্কৃতির নির্মম পরিণতি। এই কলামে আমরা সেই ব্যর্থতাগুলোকেই একে একে উন্মোচন করার চেষ্টা করব।

এটি ছিল রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার নিষ্ঠুর পরিণতি। যুদ্ধবিমানের উড্ডয়নপথ, জরুরি প্রটোকল, নিরাপত্তার খতিয়ান- সব কিছুই যেন নেই। শিশুদের মৃত্যু হলো রাষ্ট্রের সীমাহীন গাফিলতির প্রতীক হয়ে। এই মৃত্যু আকাশ থেকে আসেনি, এটি এসেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিচু নৈতিকতা থেকে। বিমান চলাচলের নিরাপত্তা, শহরের ওপর দিয়ে বিমান উড্ডয়নের অনুমতি, জরুরি পরিস্থিতিতে বিকল্প রুট ও অটোমেটিক ইজেকশন ব্যবস্থা- সব কিছুতেই ছিল গলদ। অথচ এগুলো থাকা উচিত ছিল একটি সচেতন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোতে। প্রশ্ন ওঠে, কেন এখনো আমরা ৪৮ বছর পুরোনো বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছি? কেন আধুনিকীকরণের নামে বরাদ্দের টাকা গিয়ে পড়ে অজানা খাতে? এই মৃত্যু শুধু পাইলটের নয়, নিচে থাকা নিরপরাধ শিশুদের- এটা এক সম্মিলিত ব্যর্থতার ফল, যার দায় শুধু একজন বা দুজনের নয়, পুরো ব্যবস্থার।

আর শোক নয়, চাই রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি! শোক দিবস পালনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই শোকের ফল কী? যদি কোনো দায় নির্ধারিত না হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতে আনা না হয়, তবে শোক কেবলই আবেগ। শিশুদের মৃত্যু কেবল দুঃখজনক নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। কাজেই চাই কাঠামোগত ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে সুরক্ষিত, প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হবে সত্যিকার। শোককে প্রতিবাদে রূপান্তর করতে না পারলে, এই শিশুরা কেবল স্মৃতি হবে। আমরা কি শুধু মোমবাতি জ্বালিয়ে দায় শেষ করব? নাকি এই মুহূর্ত থেকেই দাবি তুলব- ‘প্রত্যেক শিশুর জন্য নিরাপদ স্কুল চাই’? আমরা কি কেবল ক্ষণিকের শোক দেখিয়ে রাষ্ট্রকে রেহাই দেব? নাকি এবার হিসাব চাইব, কোন বিভাগ ব্যর্থ, কোন কর্মকর্তা ঘুমাচ্ছিলেন, কার গাফিলতিতে এই প্রাণ হারাল? রাষ্ট্র যদি জবাব না দেয়, তবে জনতার রাস্তাই একমাত্র জবাবদিহির পথ। সময় এসেছে শোককে বদলে দেওয়ার, প্রতিরোধে রূপান্তর করার। এখনই সময় প্রশ্ন তোলার-‘রাষ্ট্র কার জন্য?’

বাংলাদেশে ট্র্যাজেডির ইতিহাস দীর্ঘ- তাজরীন থেকে চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইলস্টোন। কিন্তু কয়টায় বিচার হয়েছে? কয়টি পরিবার পেয়েছে ন্যায়বিচার? বিচারহীনতা যেন এই দেশের নতুন নিয়ম। এই সংস্কৃতিই বারবার অপরাধীদের সাহসী করে তোলে। শিশুদের মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না, না ভবনের মালিক, না প্রশাসন, না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদি এবারও বিচার না হয়, তবে নিশ্চিত জানবেন, আগামী মৃত্যুর জন্যও আমরা প্রস্তুত করছি মঞ্চ। বিচার চাইলে যারা বলে ‘ঘোলা পানিতে মাছ ধরছো’- তাদেরই চোখের সামনে তৈরি হয় নতুন শবদেহ।

কি আশ্চর্য ব্যাপার! এত বড় এক শিশুমৃত্যু, অথচ কেউ পদত্যাগ করল না! কেউ দায়িত্ব নিল না! বরং ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত অনেকেই। আমাদের দেশে কীভাবে যেন প্রতিটি ঘটনা চাপা পড়ে যায় ‘তদন্ত চলছে’- এর আড়ালে। প্রশ্ন হলো, এত মৃত্যু দেখেও যারা দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না, তারা কীভাবে নীতিনির্ধারক হন? একজন শিক্ষামন্ত্রী, একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা, একজন সিটি করপোরেশনের প্রধান, তারা কীভাবে ঘুমান? এই নৈঃশব্দ্য যেন এক নিষ্ঠুর অভ্যস্ততা, যেখানে রাষ্ট্র শুধু দেখেও না দেখার ভান করে।

শিশুর মৃত্যু রাজনৈতিক নীরবতা ভাঙে। এই মৃত্যু শুধু স্কুলের দেয়াল ভেঙে দেয়নি, ভেঙে দিয়েছে আমাদের নিস্পৃহতার দেয়ালও। রাজনীতিকরা যেভাবে চুপ থেকেছেন, তা আরেকটি জাতীয় লজ্জা। সংসদে এক মিনিট নীরবতা, কিছু শোকবার্তা, আর কিছু বিলাপ, এই কি আমাদের শিশুদের জন্য যোগ্য সম্মান? এ ঘটনায় তো কোনো কমিটি পর্যন্ত হয়নি সংসদে। কই, কোথায় সেই শিশুবান্ধব রাজনীতি? তারা কি কেবল বক্তৃতার জন্য? কেবল বাণী পাঠিয়ে দায় শেষ? শিশুদের মৃত্যু নিয়ে যদি রাষ্ট্রনায়করা রাজনীতির বাইরে এসে কিছু বলেন না, ব্যবস্থা না নেন, তাহলে জনগণের চোখে তারা আর নায়ক থাকবেন না। আজ যদি শিশুদের মৃত্যুতে কোনো দল এক প্ল্যাটফর্মে না আসে, তবে কবে আসবে? যখন সব শেষ?

মিডিয়া চতুর্থ স্তম্ভ না ক্ষণস্থায়ী শোকদূত? মিডিয়া হয়ত প্রথম দুদিন সরব থাকে, লাইভ কাভারেজ, রিপোর্টারদের কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা গলা। কিন্তু তারপর? ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। এরপর অন্য কোনো সেলিব্রিটি স্ক্যান্ডাল বা রাজনীতির তর্জা এসে ঢেকে দেয় শিশুর পোড়া চামড়ার গন্ধ। এটাই কি গণমাধ্যমের ভূমিকা? নিউজরুমগুলোতে কি সত্যিই শিশুদের মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ থাকে? নাকি ‘ট্রেন্ড’ শেষ হলেই রিপোর্টার বদল? মিডিয়াকে জানতে হবে- এই ঘটনা শুধু সংবাদ নয়, এই ট্র্যাজেডি ইতিহাসের অংশ। সাংবাদিকতা কেবল খবর পরিবেশন নয়, দায়িত্বশীলতার নামও বটে।
জনতার আন্দোলনই একমাত্র ভাষা : যতক্ষণ না পর্যন্ত জনতা রাস্তায় নামছে, ততক্ষণ এই রাষ্ট্র নড়বে না। শিশুর মৃত্যুতে যদি আমরা শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাস দিই, তাহলে দায় আমাদেরও। একটি নয়, দশটি নয়, এই দেশে শত শত শিশুর মৃত্যু ঘটেছে অব্যবস্থাপনায়। এবার সময় এসেছে, ‘নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন চাই’, ‘দুর্নীতিমুক্ত জরুরি ব্যবস্থা চাই’, ‘পুরোনো যুদ্ধবিমান বাতিল চাই’- এসব দাবিতে সারাদেশ কাঁপানোর। আজ যারা স্কুলে, কাল তারা রাষ্ট্র চালাবে। কিন্তু যদি আজ তাদের নিশ্চিন্তে ক্লাসে বসতে না দেওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কোথায়?

তারা বই হাতে স্কুলে এসেছিল, ক্লাসে বসতে, খেলতে, ভবিষ্যতের গল্প শুনতে। কেউ ডাক্তার হতে চেয়েছিল, কেউ শিক্ষক, কেউ হয়তো কেবল খেলার ছলে বড় হতে চেয়েছিল। কিন্তু ফিরে গেল না আর। কাঁধে বই নয়, উঠল কফিন। টিফিন বক্সে রাখা খাবার শুকিয়ে গেল, খুলে দেখারও সময় হলো না। মা টিফিনে আদর রেখেছিল, সেই আদরও অভিশাপে রূপ নিল।

এই কলাম লিখতে লিখতে কাঁপছে আঙুল, ঝাপসা হয়ে আসছে পর্দা। কারণ ওরা তো আমার-আপনার ঘরের শিশুই। আপন ঘরের হাসি, স্বপ্ন, অবুঝ জেদ। আর কতটা নিস্তরঙ্গ শিরোনাম হলে কানে পৌঁছবে শাসকের? আর কত শিশুর প্রাণ গেলে আপনার ঘুম ভাঙবে? না হয় ধরে নেব, আমরা এক নিষ্প্রাণ প্রজাতি- যাদের চোখে জল আছে, কিন্তু হৃদয়ে দাহ নেই।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!