শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. আফজাল হোসেন সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সমাজ বিশ্লেষক

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

জুলাই শহিদ দিবস: গণতন্ত্রের রক্তিম সূর্যোদয় ও মানুষের প্রত্যাশা

মো. আফজাল হোসেন সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সমাজ বিশ্লেষক

প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০২৫, ০১:২৮ এএম

জুলাই শহিদ দিবস: গণতন্ত্রের রক্তিম সূর্যোদয় ও মানুষের প্রত্যাশা

১৬ জুলাই, তারিখটি এখন আর কেবল একটি দিন নয়, এটি আজ বাঙালির ইতিহাসে এক উত্তপ্ত আবেগের প্রতীক, গণজাগরণের এক স্থায়ী স্তম্ভ, এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায়বোধের নবজন্মের দিন। ২০২৪ সালের এই দিনে রক্ত ঝরেছিল একটি স্বপ্নের জন্য, বিসর্জন এসেছিল এক নির্ভীক ছাত্রের বুক দিয়ে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ, ঢাকার দুই যুবক, চট্টগ্রামের দুই শিক্ষার্থী ও এক পথচারীসহ মোট ছয়জন শহিদের আত্মত্যাগে সূচিত হয়েছিল যে আন্দোলন, তা এক বছরের ব্যবধানে রাষ্ট্রকাঠামোকে বদলে দিতে পেরেছে। এই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জুলাই শহিদ দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবে এটি কেবল শহিদদের স্মরণ নয়, এটি এক নবপ্রত্যয়ের শপথ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভিযাত্রায় যাত্রা-বিন্দুতে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখা, আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান।

আবু সাঈদ : যে বুক থেকে জেগেছিল প্রতিরোধ:- ১৬ জুলাই ২০২৪। দুপুরের আগুনঝরা রোদ্দুরের নিচে দেশজুড়ে ছিল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী মিছিল ঠেকাতে আসে পুলিশ। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে যান আবু সাঈদ। হাতে বাঁশের লাঠি, মুখে দৃপ্ততা, চোখে এক অমল ধ্রুবতারার মতো বিশ্বাস, এই রাষ্ট্র একদিন জনগণের হবে। তিনি দুই হাত প্রসারিত করে নিজের বুক পেতে দেন পুলিশের গুলির সামনে। একটি গুলি এসে ছিন্ন করে দেয় তার বুকে লুকিয়ে রাখা হাজারো স্বপ্ন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই মর্মন্তুদ ভিডিও। মুহূর্তেই তপ্ত হয়ে ওঠে জনতার রক্ত, স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে শহরতলী, গ্রাম থেকে বন্দরে। এই দৃশ্য ছিল বিদ্যুৎসম এক আলোকপাত, আবু সাঈদের মৃত্যুই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট। তার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে জন্ম নেয় এক নবজাত আন্দোলন।

জাগরণের দাবানল : এক সপ্তাহে পাল্টে গেল ইতিহাস:- সেই রাতে, সারাদেশ জেগে ওঠে। ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সবাই রাস্তায় নামে। পরদিন থেকে টানা শাটডাউনে অচল হয়ে পড়ে বন্দর, শিল্পাঞ্চল, প্রশাসনিক শহর। এই বিক্ষোভ আর কেবল আবু সাঈদের হত্যার প্রতিবাদ ছিল না; এটি ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ, স্বৈরাচার, দুর্নীতি, মত প্রকাশে বাধা, ভোট ডাকাতি ও দমননীতির বিরুদ্ধে এক জনগণিক প্রতিরোধ।

আর সে প্রতিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি এলো মাত্র ২০ দিন পরে, ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইতিহাস ঘুরে যায়। জুলাই অভ্যুত্থান নামে পরিচিত এই গণজাগরণ তখন কেবল এক রাজনৈতিক পালাবদল নয়, হয়ে ওঠে এক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা।

আশা ও প্রত্যাশার নতুন ঠিকানা : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার:-
৫ আগস্টের পতনের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনমনে তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব আশাবাদ, দেশে গণতন্ত্র ফিরবে, বাক-স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা ফিরে আসবে, শাসন হবে জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের অবসান হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গঠিত হয় একাধিক সংস্কার কমিশন, যার অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও মিডিয়া স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। যদিও এই প্রক্রিয়াগুলো সময়সাপেক্ষ এবং জটিল, তবে এগুলোর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের স্থায়ী গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণের পথ তৈরি হচ্ছে।

নতুন পথের দিশা : মানুষের প্রশ্ন, উত্তরের খোঁজে:- জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে- ‘লক্ষ্যে পৌঁছাতে আর কতদূর?’ কিংবা, ‘এই আত্মত্যাগের ফল কবে নাগাদ সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত হবে জীবনের প্রতিটি পরতে?’ এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, এ অভ্যুত্থান শুধু সরকার পতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা। সুতরাং এর সফলতা নির্ভর করছে কত দ্রুত এবং কতটা আন্তরিকতায় কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়িত হয়।

ন্যায়বিচারের দাবি : শহিদের রক্তের প্রতিদান:- আজ যখন আমরা আবু সাঈদের ছবি দেখি, তার সেই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য আমাদের চোখে জল আনে। কিন্তু কেবল আবেগ দিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না, দরকার ন্যায়বিচার। যারা সেদিন সাঈদসহ আরও পাঁচজন শহিদকে হত্যা করেছে, যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করতে গুলি ছুড়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা আজ সময়ের দাবি, শহিদের রক্তের দাবি। ন্যায়বিচার ছাড়া অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায় না। এটি কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।

জুলাই শহিদ দিবস : রক্তের অক্ষরে লেখা গণতন্ত্রের নতুন নাম:- রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৬ জুলাইকে ‘জুলাই শহিদ দিবস’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার শহিদদের সম্মান জানিয়েছে, ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়েছে। এদিনে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সারা দেশে আলোচনা সভা, প্রার্থনা, সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়।

তবে এই দিনকে স্মরণীয় করতে হলে চাই এর অন্তর্নিহিত বার্তাকে ধারণ করা, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র রক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা।

সংস্কারবান্ধব, মানবিক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত। তা না হলে শহিদের আত্মত্যাগের চরম অবমাননা হবে। ইতিহাস আমাদের বারবার শিক্ষা দিয়েছে, গণতন্ত্রকে চাপা দিলে সে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে, আরও বিস্ফোরক হয় জনতার ঘুমন্ত আবেগ।

জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষই ইতিহাসের চালক। পঁচাত্তরের পর, নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর, আবারও ২০২৪-এর জুলাই দেখিয়েছে, এই দেশের মানুষ শাসকের নয়, নিজ অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে দাঁড়াতে জানে।

তবে এই অভ্যুত্থানকে সফল করতে হলে কেবল সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, আমাদের প্রত্যেক নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। একদিনের প্রতিবাদ বা এক বছরের পরিবর্তন দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি হয় না। এটি সময়সাপেক্ষ, ধৈর্যনির্ভর ও অংশগ্রহণমুখী এক যাত্রা। যেখানে শিক্ষক হবেন চিন্তার আলো জ্বালানোর প্রহরী, সাংবাদিক হবেন সত্যের পক্ষের সৈনিক, বিচারক হবেন নিরপেক্ষতার প্রতীক, আর নাগরিক হবেন সচেতন, দায়িত্ববান।

শেষ কথা : শহিদ সাঈদের চোখ দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো। এ বছর যখন রক্তঝরা সেই ১৬ জুলাই ফিরে আসে, আমরা চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই এক তরুণ, আবু সাঈদ। হাতে লাঠি, বুক খোলা, চোখে সাহস। সেই চোখ দিয়ে তাকালে আমরা দেখতে পাই একটি স্বপ্নময় বাংলাদেশ, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, ভোটাধিকার থাকবে, নিরাপদ জীবন থাকবে, থাকবে না আর ভয়, নিপীড়ন, কিংবা স্বৈরশাসনের ছায়া। শহিদের সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে এখন প্রয়োজন অটল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নাগরিক সংহতি। তাহলেই একদিন বাংলাদেশের মানুষ ফিরে পাবে তার হারানো গণতন্ত্র, তার মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যার জন্য সাঈদরা বুক পেতে দিয়েছিল। জুলাই শহিদ দিবস কেবল স্মরণের নয়, এটি সময়ের ডাক, একটি রক্ত¯œাত স্বপ্নকে সত্য করে তোলার শপথের দিন।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!