উত্তরার দিয়াবাড়ির একটি শান্ত সকাল যেন আচমকাই পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে, যেখানে আকাশ থেকে ধসে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান, গন্তব্যহীনভাবে ভেঙে পড়ে মিলস্টোন স্কুলের ওপর।
শিশুরা, শিক্ষক, পথচারী, নিরীহ ও অপ্রস্তুত প্রাণেরা হারিয়ে যায় একটি প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার কাছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনাটি কি শুধুই একটি যান্ত্রিক ত্রুটির ফল? না কি এটি এক দীর্ঘদিনের অবহেলিত রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া? এই ঘটনার পেছনে যে নীতিগত ফাঁকফোকর, কূটনৈতিক দুর্বলতা ও কৌশলগত ভুল সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা যেন একটি বিমানের পতনের চেয়েও অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
পুরোনো বিমান, পুরোনো চিন্তা : ‘এফ-৭ বিজিআই’ এক ব্যর্থতার প্রতীক
‘এফ-৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানটি কোনো আধুনিক প্রযুক্তির ফল নয়। এটি একটি পুরাতন মডেল, চীনের তৈরি, যার ভিত্তি ১৯৬০-এর দশকের মিগ-২১ প্ল্যাটফর্মে। কিছুটা আধুনিকীকরণ করে এগুলো বাংলাদেশের আকাশে ওড়ানো হচ্ছে, অথচ আজকের যুগে এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বহু প্রশ্ন উঠেছে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ ১৬টি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান কিনেছিল চীন থেকে। এর মূল কারণ ছিল খরচ কম এবং রাজনৈতিক জটিলতা কম। চীন বরাবরই স্বল্পমূল্যে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে থাকে এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মতো মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক মানদ-ের শর্ত আরোপ করে না। এ কারণে চীন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী। কিন্তু এই সুবিধাজনক সম্পর্ক আজ কী মূল্য দিচ্ছে আমাদের? বিমান ভেঙে পড়ছে স্কুলে। প্রশ্ন উঠছে, ২০২৫ সালে এসে কেন এখনো ¯œায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রযুক্তিতে আকাশ রক্ষা করার চেষ্টা করছি?
সামরিক নির্ভরতা : যে বন্ধুত্বে স্বাধীনতা সংকুচিত
বাংলাদেশের সামরিক আমদানির প্রায় ৬৫% আসে চীন থেকে। যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, রকেট সিস্টেম, রাডার সবকিছুরই বড় অংশ সরবরাহ করে চীন। রাশিয়া থেকেও কিছু সামরিক সরঞ্জাম আসে এবং সম্প্রতি তুরস্ক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন উৎসে পরিণত হয়েছে। এটি নিছক একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়; এটি এক গভীর কৌশলগত নির্ভরতা। এই নির্ভরতাই আমাদের সীমিত করেছে- আমরা নিজের মতো করে প্রতিরক্ষা কৌশল ঠিক করতে পারি না, যেহেতু আমাদের প্ল্যাটফর্ম, প্রশিক্ষণ, খুচরা যন্ত্রাংশ সবই নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর নির্ভরশীল। এই ধরনের ‘এক্সটারনাল ডিপেন্ডেন্সি’ শুধু আমাদের প্রযুক্তিগত নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে। ফলে আমরা চাইলেও অনেক সময় স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে পারি না।
চীনা অস্ত্র, পশ্চিমা বাজার, উভয়ের মাঝে টানাপোড়েনের বাংলাদেশ
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় ভরকেন্দ্র হলো তৈরি পোশাক শিল্প। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই খাতের প্রধান ক্রেতা। অপরদিকে, প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান সরবরাহকারী চীন। এখানে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। আমরা যাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই, তারা আমাদের সমালোচনা করে মানবাধিকার ইস্যুতে। আর যাদের কাছ থেকে আমরা নিরাপত্তা চাই, তাদের তৈরি সরঞ্জামই আমাদের নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রে পশ্চাদপসরণ এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। এই পদক্ষেপের ফলে কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হয়, শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামে, রপ্তানি কমে যায় এবং সরকার চাপে পড়ে। একদিকে আমরা চীনের কাছ থেকে সস্তা অস্ত্র নিচ্ছি, অন্যদিকে এই সম্পর্কের খেসারত দিচ্ছি পশ্চিমা বাজার হারিয়ে। এটা যেন একটি খেলার বোর্ড, যেখানে বাংলাদেশ হচ্ছে দুই রাণীর মাঝে আটকে থাকা এক দুর্বল ঘুঁটি।
‘কৌশলগত ভারসাম্য’ নীতির অপমৃত্যু?বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই এক ধরনের ‘স্ট্র্যাটেজিক ব্যালান্সিং’ বা কৌশলগত ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউরোপ, সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা, কোনো একটি পক্ষকে বিরক্ত না করা এই নীতির মূল ভিত্তি ছিল। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা অনেক কঠিন ও ধ্রুব হয়ে পড়েছে। বিশ্ব এখন বিভক্ত শিবিরে পরিণত হয়েছে, চীন বনাম পশ্চিম, স্বৈরতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, স্বার্থ বনাম আদর্শ। এই বাস্তবতায় দ্বিধান্বিত অবস্থানে বসে থাকা আর কার্যকর কোনো কৌশল নয়। এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশকে তার অবস্থান আরও স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করার।
দিয়াবাড়ি ট্র্যাজেডি : পররাষ্ট্রনীতি এখন মানুষের জীবন-মরণের বিষয়, সাধারণ নাগরিকদের জন্য পররাষ্ট্রনীতি সবসময়ই একটি দূরবর্তী বিষয় বলে মনে হয়, যা তাদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। কিন্তু যখন চাকরি হারাতে হয়, বা কোনো যুদ্ধবিমান স্কুলে ভেঙে পড়ে, তখন এই নীতিগুলো বাস্তব ও নির্মম হয়ে ওঠে। এই ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় পররাষ্ট্রনীতি মানে কেবল রাষ্ট্রের মানচিত্র বা সামরিক সম্পর্ক নয়; এটি মানে মানুষের জীবন, নিরাপত্তা, মর্যাদা। যেসব সিদ্ধান্তে এই মানবিক দিক অনুপস্থিত থাকে, সেগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থ হতেই বাধ্য।
নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন চিন্তা : কী করতে হবে এখন?
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে:
* পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানে গুরুত্ব দিতে হবে।
* পুরোনো বিমান বা প্রযুক্তির পরিবর্তে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে পরীক্ষিত ও নিরাপদ সরঞ্জামে, যদিও সেগুলোর সংখ্যা কম হয়।
* রক্ষণাবেক্ষণ, ক্রু প্রশিক্ষণ, এবং অপারেশনাল স্ট্যান্ডার্ড আরও আধুনিক করতে হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে:
* গার্মেন্টস নির্ভরতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে প্রযুক্তি, ওষুধ, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পর্যটন ও নৌযান শিল্পে বৈচিত্র্য আনতে হবে।
* শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, পরিবেশগত মান, এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পশ্চিমাকে খুশি করার জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্য।
নতুন পররাষ্ট্রনীতি : সহযোগিতা চাই, আধিপত্য নয়
বাংলাদেশকে এখন সময়োপযোগী, সাহসী ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ এক পররাষ্ট্রনীতির পথে হাঁটতে হবে। আমাদের বার্তা হওয়া উচিত স্পষ্ট ও দৃঢ়, আমরা কোনো পরাশক্তির আনুগত্য চাই না, আবার কারো করুণা বা একতরফা শর্তেও নির্ভর থাকতে রাজি নই। আমরা চাই সম্মানভিত্তিক সহযোগিতা, যেখানে সম্পর্ক হবে সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থে গঠিত। অংশীদারিত্ব হোক সম্মানজনক, যার ভিত্তি হবে সংলাপ, স্বার্থের ভারসাম্য এবং আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি। বাংলাদেশের উন্নয়ন কেবল বৈদেশিক বিনিয়োগ, অনুদান বা রপ্তানির ওপর নির্ভর করে না, এর ভিত্তি আমাদের জনগণের শ্রম, দক্ষতা ও সম্ভাবনার ওপর গঠিত। তাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকেও সেই জনগণের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নের প্রতিফলন হতে হবে। এই যুগে পররাষ্ট্রনীতি আর কেবল কূটনৈতিক ব্যাকরণ নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়, সাহসিকতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার আয়না।
দিয়াবাড়ির শোক যেন হোক জাগরণের আলো
এই দুর্ঘটনা যেন কেবল একটি খবরের ঘটনা না হয়। এটি হতে পারে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত। আমাদের প্রতিটি কৌশলিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে রাখতে হবে একটি প্রশ্ন, এই সিদ্ধান্ত কি দেশের মানুষকে রক্ষা করে? তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে? এই জটিল ও বিভক্ত বিশ্বে সহানুভূতি, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র শুধু স্বপ্ন নয়, এটাই সবচেয়ে জরুরি। আমরা এই দায় শুধু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের নয়, বরং ঋণী সেই নিষ্পাপ শিশুদের কাছে, যারা দিয়াবাড়ির মাটিতে অকালে হারিয়ে গেছে।