রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের কামচাটকা উপদ্বীপে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। দেশটির পূর্ব উপকূল ও আশপাশের এলাকা স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার সকালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। পরবর্তী সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সুনামি আতঙ্ক, যা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে জাপান। গতকালের ভূমিকম্পটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
এদিকে ভূমিকম্পের ফলে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, পেরু, ফিলিপিন্স ও মেক্সিকোসহ প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী অনেক দেশে এরই মধ্যে সতর্কতামূলক নানা নির্দেশনা জারি করেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে তীরসংলগ্ন ও নিচু এলাকার লোকজনকে উঁচু এলাকায় স্থানান্তর কিংবা অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলেছে। জাপান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকায় এরই মধ্যে সুনামির ঢেউ আঘাত হানতে শুরু করেছে, কোথাও কোথাও আরও পরে আঘাত হানবে, এ কারণে সাগরের ঢেউ ও এর উচ্চতার দিকে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিবিড় নজর রাখছে। জাপান তীরসংলগ্ন ১৯ লাখ লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছে, সুনামির ঢেউ এক দিনের বেশি সময় ধরে আছড়ে পড়তে পারে বলে দেশটির কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের সতর্ক করেছে বলেও জানিয়েছে বিবিসি। দেশটিতে উত্তর উপকূলে ৪০ সেন্টিমিটার (প্রায় দেড় ফুট) উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখা গেছে। এ উচ্চতা তিন ফুট পর্যন্ত উঠে যেতে পারে বলেও সতর্ক করেছে আবহাওয়া বিভাগ।
দেশটির অনেককে উঁচু উঁচু সব ভবনের ছাদে আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে। ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কর্মীদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জিওফিজিক্যাল সার্ভিস অব দ্য রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের বরাতে আরআইএ জানিয়েছে, গতকাল সকালে ভূমিকম্পের পর আগ্নেয়গিরির উদগীরণ শুরু হয়েছে। আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইয়ে আকাশ ঢেকে গেছে, যা এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ কিলোমিটার উচ্চতায় ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লিউচেভস্কয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের রুট না থাকলেও আঞ্চলিক ফ্লাইটের জন্য রাশিয়ার বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’ জারি করেছে। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভলকানোলজি ও সিসমোলজি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, আগ্নেয়গিরির মুখ প্রায় লাভায় পূর্ণ হয়ে গেছে। যেকোনো সময় লাভা গড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, স্থানীয় সময় গতকাল সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। সংস্থাটি বলছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল রাশিয়ার পেত্রোপাভলোভস্ক-কামচাতস্কি শহর থেকে ১৩৬ কিলোমিটার বা প্রায় ৮৫ মাইল পূর্বে, প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। তবে এখন পর্যন্ত হতাহত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য মেলেনি। রিং অব ফায়ার বলয়ের কারণে রাশিয়ার কামচাটকা অঞ্চলে প্রায়ই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটিকে দশকের অন্যতম শক্তিশালী বলে মন্তব্য করেছেন কামচাটকা অঞ্চলের গভর্নর। ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ছে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তর উপকূলে আঘাত হানছে সুবিশাল ঢেউ। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আছড়ে পড়েছে ৫ দশমিক ৫ ফুট (১ দশমিক ৭ মিটার) পর্যন্ত উঁচু ঢেউ। এদিকে, উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রিসেন্ট সিটিতে ৩ দশমিক ৬ ফুট (প্রায় ১ দশমিক ১ মিটার) উচ্চতার ঢেউ আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন জাতীয় সুনামি সতর্কতা কেন্দ্র। ক্যালিফোর্নিয়ার কেপ মেনডোসিনো থেকে ওরেগন সীমান্ত পর্যন্ত এলাকায় এখনো সুনামি সতর্কতা বলবৎ রয়েছে। এর আগে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার এরিনা কোভে ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ১ দশমিক ৬ ফুট (প্রায় ০ দশমিক ৪৮ মিটার); পরে তা বেড়ে ৩ ফুট (প্রায় ০ দশমিক ৯ মিটার) হয় বলে জানায় সুনামি সতর্কতা কেন্দ্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুনামি সতর্কতা নিয়ে সচেতন থাকতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ওয়াশিংটন, সান ফ্রান্সিসকো, অরেগন, এবং আলাস্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল এমনকি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতেও সুনামি সতর্কতা জারি রয়েছে। একুয়েডর, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, কলম্বিয়াসহ আরও বেশ কিছু দেশে বিভিন্ন মাত্রার সুনামি ঝুঁকির সতর্কতা জারি রয়েছে। কোথায় কী ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি রয়েছে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সুনামি সতর্কতা কেন্দ্র বলেছে, এ ভূমিকম্পের কারণে রাশিয়া ও একুয়ডরে ৩ মিটার (৯ দশমিক ৮ ফুট) পর্যন্ত উচ্চতার ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে। জাপান, চিলি, পেরু, কোস্টারিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আরও কিছু দ্বীপপুঞ্জে ১ থেকে ৩ মিটার উচ্চতার ঢেউয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতেও সুনামি সতর্কতা জারি রয়েছে। তবে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার বাকি অংশে সরাসরি সরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই; তবু উপকূল, নদীর মোহনা ও সৈকত এলাকা থেকে সবাইকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সুনামি আতঙ্ক। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া সংস্থা ও সুনামি সতর্কতা কেন্দ্রগুলো একযোগে সতর্কতা জারি করেছে। তিনটি ভিন্ন মাত্রার ঢেউয়ের আশঙ্কা অনুযায়ী বিশ্বের ৫২টি দেশ ও অঞ্চল এই সতর্কতার আওতায় এসেছে।