বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রাহুল শেখ

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ০১:০৭ এএম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির শেকড়

রাহুল শেখ

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ০১:০৭ এএম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির শেকড়

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় আধুনিকায়ন এক অনিবার্য ও বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন এবং মানুষের সৃজনশীল চিন্তাধারা মানবসভ্যতাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সমাজ, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস এমনকি চিন্তাধারারও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু কখনো কখনো এই পরিবর্তনের ধারা আমাদের ভিত্তি বা মূলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে, আধুনিকতা কি তবে আমাদের নিজস্ব পরিচয় বিলীন করে দিচ্ছে?

বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য : এক স্বতন্ত্র পরিচয়
বাংলা নামক এই জনপদ হাজার বছরের পুরোনো এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, বাচনভঙ্গি, স্থাপত্যশৈলী এবং জীবনদর্শনে বাঙালি জাতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে গড়ে উঠেছে। বাঙালির রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যা নিজেদের শেকড়কে অন্য জাতির সামনে তুলে ধরার আকাক্সক্ষা জাগায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আধুনিকায়নের নামে বহুজাতিক সংস্কৃতি বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে এক ভয়াবহ রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

উন্নয়নের আড়ালে আত্মপরিচয়ের সংকট:
অনেকেই এই রূপান্তরকে উন্নয়ন বলে অভিহিত করলেও, এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে বাঙালির নিজস্ব স্বতন্ত্র পরিচয় মুছে দেওয়ার এক করুণ গল্প। আধুনিকায়ন আমাদের এনে দিয়েছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সুবিধা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুউচ্চ দালান-কোঠা, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে এগুলো আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করেছে। কিন্তু এই আধুনিকতার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ পরিবেশ, নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষার মাধুর্য, লোকসংস্কৃতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – আত্মিক সম্পৃক্ততা।
অনেকে মনে করেন, ঐতিহ্য মানেই পুরোনো, সময়ের সঙ্গে বেমানান; তাকে ছুড়ে ফেলায় শ্রেয়। কিন্তু এই ঐতিহ্যই আমাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে, যা বিশ্বের অন্য সব জাতি থেকে নিজেদের পৃথক করতে সহায়তা করে।

বিলুপ্তির পথে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি:
বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য,  নকশিকাঁথা, পটচিত্র, বাউলগান, মঙ্গলশোভাযাত্রা, একতারা। আধুনিকতার দাপটে এগুলো আজ অনেকটাই কোণঠাসা। অথচ এগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালির পূর্বপুরুষের জীবনগাথা, আবেগ, ভালোবাসা এবং জাতি হিসেবে নিজেদের স্বকীয়তা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ আধুনিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার পথে বাঙালির এই ইতিহাস-ঐতিহ্য। সমাজের নি¤œবর্গ থেকে উচ্চবর্গ পর্যন্ত কেউই যেন এগুলোর সংরক্ষণে আগ্রহী নয়।

এক সময় বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের চিত্র ছিল:
আবেগপ্রবণ, যেখানকার প্রতিটি কোণায় কোণায় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য মিশে ছিল। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপ দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না।’ জীবনানন্দ দাশের এমন উক্তিই বুঝিয়ে দেয় বাংলার প্রকৃতি ও গ্রামীণ সৌন্দর্যের গভীরতা। কিন্তু আজ বাংলার প্রাকৃতিক ও গ্রামীণ সৌন্দর্য ঢেকে যাচ্ছে কংক্রিটের দেয়ালে; নিঃশেষ করে দেওয়া হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের জীবিকা নির্বাহের চিরায়ত মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল। আধুনিকায়নের নামে শহর গড়তে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, কৃষিনির্ভর জীবনব্যবস্থা এবং সরল জীবনের ঐতিহ্য।

উৎসব, ভাষা ও পোশাক : ঐতিহ্যের অবক্ষয়:
যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা বৈশাখী মেলা, কৃষকের ঘরে নতুন ফসল এলে নবান্ন উৎসব, চিরায়ত হালখাতা আজ যেন বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ সমাজে এখনো হালখাতার প্রচলন কিছুটা পরিলক্ষিত হলেও, শহরে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের এমন সব ঐতিহ্যঘেরা উৎসব সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে। তারা শহুরে ধাঁচে জীবনকে পরিচালনা করতে গিয়ে নিজেদের শেকড় ভুলে যাচ্ছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু নিজ ভাষা রক্ষার আন্দোলনই ছিল না, বরং তা ছিল বাঙালির সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রক্ষার আন্দোলন। আজ বাংলা ভাষার স্থলে সব অফিস-দপ্তরে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই বাংলা উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে থাকেন। একসময় প্রতিটি উৎসব-অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি ছিল খুবই চমকপ্রদ ঘটনা। দর্শকসমাজ হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে কবিতা বোঝার চেষ্টা করতেন, যা নিজ সংস্কৃতিকে ধারণ করার এক অনন্য উদাহরণ। অথচ আজ আমরা নিজ সংস্কৃতি এড়িয়ে গিয়ে যাদের সংস্কৃতি লালন করছি, তারা কখনোই নিজেদের শেকড়কে অবহেলা করে না। পশ্চিমা দেশগুলো নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়ে আপোসহীন ভূমিকা পালন করে থাকে।

পোশাক হচ্ছে সংস্কৃতির বহির্প্রকাশ। শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি-পায়জামা, সালোয়ার-কামিজ; যা বাঙালি জাতির চিরায়ত পোশাক। নানা বাহানায় আজ এগুলো বিলুপ্তির পথে। এগুলোর ব্যবহার যেন আজ বাঙালি জাতিকে উন্নত দেশগুলো থেকে পিছিয়ে ফেলছে বলেই মনে করা হয়। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের স্থলে আজ পশ্চিমা দেশগুলোতে ব্যবহৃত পোশাক যেন বাঙালি জাতির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

খাদ্য ও বিনোদন : শেকড় হারানোর গল্প :
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে, যা নিজ শেকড়কে মনে করিয়ে দেয়। পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন উৎসব-অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ বলে মনে হতো। বিভিন্ন ধাঁচের পিঠা, মুড়ি, মোয়া, দই, পায়েস, এগুলো ছিল আপ্যায়নের প্রধান খাদ্যসামগ্রী। এগুলোর স্থলে আজ বিদেশি খাবার, বিদেশি ধাঁচের আপ্যায়ন আমাদের আকৃষ্ট করছে। আর এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির শেকড়।একসময় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী হাডুডু খেলা, গরুর গাড়ি, লাঙল দিয়ে হাল চাষ, বিবাহের জন্য পালকি, সমাজে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে গ্রাম আদালত আজ যেন বিলুপ্তপ্রায়। অথচ এগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বাঙালি জীবনের প্রতিটি দিক।

আত্মিক সম্পৃক্ততা ও সাংস্কৃতিক উদাসীনতা:
বাংলার রূপকে ঐশ্বর্যম-িত করেছে মাঠ, ঘাট, বিল, নদী-নালা। ডিঙি নৌকায় মাঝি, ধান খেতে কৃষক; আপন মনে বাউল গান, জারি গান, সারি গান, লালনগীতি গেয়ে কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেয়েছে। এগুলো হয়ে উঠেছে বাঙালি জাতির প্রাণস্বরূপ। আজকের দিনে বিখ্যাত ব্যক্তি লালন শাহ, বাউল আব্দুল করিমের নাম কেউ মনে রাখতে নারাজ। তাদের রচিত গান যেন আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে পড়েছে। অথচ তাদের রচিত গানের মধ্যেই রয়েছে বাঙালি জাতির সংগ্রামী দিনের কথা, দুঃখ-দুর্দশার কথা।

সন্ধ্যা নামলেই গ্রামে চলতো নানারকম উৎসবমুখর পরিবেশ। পাড়া-মহল্লায় থাকত নাচ-গানের আমেজ। নিজেদের আত্মিক শান্তির পাশাপাশি চলত সংস্কৃতি চর্চার এক রমরমা পরিবেশ। আজ এমনসব উৎসব-অনুষ্ঠান আয়োজনের পদক্ষেপ নেই কারো মধ্যে। এমনকি এগুলো রক্ষার দিকেও কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।
একটি জাতির উন্নয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে তার মূল বা শেকড়। যা তাকে বর্তমান পরিস্থিতি অতিক্রম করার অনুপ্রেরণা জোগায়। একই সঙ্গে অমসৃণ পথকে মসৃণ করতে সাহায্য করে। আমরা নিজ সংস্কৃতি চর্চায় এতটাই উদাসীন যে, অন্য দেশের সংস্কৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের উপনিবেশিক হয়ে পড়ছি।

আধুনিকায়ন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ : এক ভারসাম্যপূর্ণ পথ:
আধুনিকায়ন নিঃসন্দেহে অপরিহার্য, তবে তা যেন আত্মবিস্মৃতির নামান্তর না হয়। আমাদের নিজ সংস্কৃতি চর্চায় গুরুত্বারোপ করতে হবে। নিজের শেকড় সম্পর্কে জানতে হবে। বিশ্বদরবারে নিজের আত্মপরিচয় প্রকাশ করতে হবে। বিশ্বের বুকে জানান দিতে হবে ঐতিহ্যে ঘেরা বাঙালি জাতি সম্পর্কে। এজন্য নিজ সংস্কৃতি চর্চায় ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের প্রতিটি সদস্যকে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজ সংস্কৃতিকে অনীহা নয়, বরং হৃদয়ে লালন করতে হবে। সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সকলের মধ্যে এক সুর থাকতে হবে, ‘আধুনিকায়ন চাই, তবে নিজ শেকড় ধরে রেখে।’

রাহুল শেখ শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Shera Lather
Link copied!