সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা সোনাখ্যাত দেশের শীর্ষ পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর অবাধে লুটপাট হয়েছে। দিনে-দুপুরে অবাধে লুটপাটের কারণে বিলীন হওয়ার উপক্রম ওই পর্যটন কেন্দ্রটি। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই জায়গাটি গত এক বছরে যেন ভয়ংকর পাথর লুটপাটের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে সাদা পাথর, অবৈধভাবে উত্তোলন করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের মারাত্মক অপচয় ঘটানো হয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এসব পাথর লুট হয়েছে প্রশাসনের চোখের সামনেই, দিনে-দুপুরে। তবুও দেখা যায়নি সময়োপযোগী কোনো কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এই নীরবতা কেবল উদ্বেগজনকই নয়, বরং স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাথরে সমৃদ্ধ একটি জায়গাকে মরুভুমিতে পরিণত করে দেওয়া হলো দিনে-দুপুরে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে যানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এমনকি প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে এই লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে যুবদলের কয়েকজন নেতা এই অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগও উঠেছে। ইতোমধ্যে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতির বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল, পাথর কোয়ারি ভাড়া দেওয়া ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে এই অব্যাহতি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাপা পাথর লুটের ঘটনা আলোড়ন তোলে। অবশেষে টনক নড়েছে দুদকের। সম্প্রতি দুদক একটি অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর জব্দ করেছে এবং সেগুলো যথাস্থানে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। দুদকের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এতদিনে এই অবস্থায় পৌঁছাতে হলো কেন? দীর্ঘ সময় ধরে যারা এই অপরাধ সংঘটন করেছে, তাদের কেবল পাথর জব্দ করে থামানো যাবে না। অপরাধীরা কারা, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর স্র্রোতের গতি নিয়ন্ত্রণে, তীর রক্ষায় পাথরের বিকল্প নেই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও পাথরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বিচারে পাথর তুললে নদীর স্রোত বাড়ে, তলদেশ ক্ষয় হয়, ভাঙন বাড়ে, পানির গুণগত মানও নষ্ট হয়। এই পাথর লুট শুধু একটি পর্যটন স্থানের সৌন্দর্যই নষ্ট করেনি, পরিবেশ-প্রতিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে।
কারা কারা এই অপরাধ থেকে সুবিধা পেয়েছে, কীভাবে পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কোথায় কোথায় তা বিক্রি হয়েছে, এসব তথ্য এখন বের করে আনা জরুরি। বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসনের কেউ যদি এ কাজে মদদ দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় উদাহরণ তৈরি না করতে পারলে ভবিষ্যতে এমন অপরাধ আরও বেড়ে যাবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন, সাদা পাথর কেবল অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, এটি পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ুর উপরেও গভীর প্রভাব ফেলে।
আমরা আশা করি, দুদকের অভিযান একবারের জন্য নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, পরিকল্পিত উদ্যোগের সূচনা হবে। শুধুমাত্র পাথর জব্দ করে নয়, এই অপরাধের মূল হোতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলেই কেবল প্রকৃত বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যেন কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি না হয়, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় আর যেন কোনো ‘সাদা পাথর চোর’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। সেই ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখবে।