বাংলাদেশ বর্তমানে এক জটিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমাদের দারিদ্র্যের হার এখন উল্টো পথে, সদ্য দেশের বেকারত্ব বেড়েছে, সেটা এখন মহামারি আকারে পৌঁছে গেছে। আর তৃতীয়ত, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এগুলো সাংঘর্ষিক, অসংগতিপূর্ণ।’ এ কথাগুলো নিছক সমালোচনা নয়, বরং বাস্তবতার নির্ভুল বিশ্লেষণ।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বাণিজ্যযুদ্ধ, এবং ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও বাংলাদেশে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যেমন ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নজর নতুন বাজারের দিকে ফিরছে। অথচ, সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বেকারত্ব হ্রাস এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ (২০২৩ সালের) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের বেকারত্বের হার ৩.৬% হলেও, প্রকৃত কর্মসংস্থান সংকট অনেক বেশি। কারণ, এই পরিসংখ্যান অনেকগুলো বিষয় প্রতিফলিত করে না। যেমন, আংশিক বেকারত্ব যেখানে একজন ব্যক্তি পুরো সময় কাজ করছেন না বা তার দক্ষতার তুলনায় কাজ পাচ্ছেন না।
দেশে প্রকৃত বেকার সংখ্যা কত, এর কোনো হিসাব নেই। সরকার বেকারের যে হিসাব দেয়, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক দশক ধরেই দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২৭ লাখ বেকার, তা কেউ মানবেন না; তবে বেকারের সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে এটাই সত্য। কিন্তু দেশে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ মনমতো কাজ পান না। তারা পড়াশোনা করেন না, কাজেও নেই। তারা ছদ্মবেকার। কোনোরকম জীবনধারণের জন্য কাজ করেন।
মোটাদাগে বেকারত্ব তিন ধরনের। যেমন- সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব, বাণিজ্য চক্রজনিত ও কাঠামোগত বেকারত্ব।
শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি থাকলে সেটিকে সামঞ্জস্যহীন বেকারত্ব বলে। উত্তরবঙ্গ ও হাওর অঞ্চলে এমন বেকারত্ব দেখা যায়। শিল্পকারখানা ও সেবা খাতে যে ধরনের লোক প্রয়োজন, সেই ধরনের লোকের সরবরাহ কম থাকলে তা সামঞ্জস্যহীন বেকারত্ব। এখন এই বেকারত্ব নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে।
এ ছাড়া অর্থনীতিতে চাঙাভাব কিংবা মন্দাভাবের কারণেও অনেক সময় বেকারত্ব বাড়ে-কমে। যেমন- কোভিডের কারণে বেকারের সংখ্যা বেড়েছিল। এটি বাণিজ্য চক্রজনিত বেকারত্ব। আবার প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণেও বেকারত্ব বাড়ে। এ ধরনের বেকারত্বকে কাঠামোগত বেকারত্ব বলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮-৩৫ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১২%। আবার শিক্ষিত যুবসমাজের একটি বড় অংশ কর্মসংস্থান না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত। এটি দেশের জন্য একটি সুপ্ত সামাজিক সংকট হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এর থেকে উত্তরণের পথ না ভাবলে ভবিষ্যৎ হবে ভয়াবহ।
‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে’ এই প্রচলিত বয়ান এখন যথেষ্ট নয়, যদি না সেই অগ্রগতি দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। বেকারত্ব একটি নীরব মহামারি হয়ে উঠেছে, যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক অস্থিরতার জন্মও দিতে পারে।
সুতরাং সরকার ও বেসরকারি খাত একযোগে বাস্তবমুখী, দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান তৈরির কৌশল গ্রহণ না করলে এই সংকট কাটানো অসম্ভব। প্রবৃদ্ধির গতি শুধু পরিসংখ্যানের অঙ্ক নয়, তা নির্ভর করে কত মানুষ মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে, তার ওপর।
আমরা মনে করি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে গুরুত্বের সঙ্গে জোর দিতে হবে। বেকারত্বের হার বাড়ছে, এবং তা সমাজে অরাজকতা ও হতাশা বাড়াচ্ছে। যদি আমরা নতুন খাতে আগ্রাসী বিনিয়োগ, বেসরকারি অংশীদারিত্ব, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে না পারি, তবে বেকারত্বের ভয়বহতা থেকে বের হওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন