বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জেসমিন চৌধুরী, কলাম লেখক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫, ০১:২১ এএম

অগ্রগতির মেরুদণ্ড নারী শিক্ষা

জেসমিন চৌধুরী, কলাম লেখক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫, ০১:২১ এএম

অগ্রগতির মেরুদণ্ড নারী শিক্ষা

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে উন্নয়ন ও পিছিয়ে পড়ার দ্বৈত স্রোত একইসঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছে। একদিকে আমরা পোশাকশিল্প, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা প্রবাসী আয় দিয়ে বিশ্বে প্রশংসা কুড়াচ্ছি, অন্যদিকে এখনো গ্রামীণ জনপদে অগণিত কিশোরী স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, শহরের অভিজাত এলাকায়ও মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথে অদৃশ্য বাধা রয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারেÑ কেন নারী শিক্ষাকে ঘিরে এখনো এত আলোচনার প্রয়োজন? কারণ সহজ: নারী শিক্ষা শুধু নারীর জীবনের প্রশ্ন নয়, এটি একটি জাতির অগ্রগতি, নৈতিক শক্তি ও টেকসই উন্নয়নের প্রশ্ন।

আজকের পৃথিবীতে কোনো রাষ্ট্র নারী শিক্ষাকে উপেক্ষা করে সামগ্রিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারেনি। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএং)-এ নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রমাণিত সত্য হলোÑ একজন নারী যত বেশি শিক্ষিত হবেন, তত বেশি তিনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখবেন। বাংলাদেশেও নারীর শিক্ষা বিস্তারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু এই অগ্রগতি এখনো অসম্পূর্ণ, এখনো খ-িত, এখনো সামাজিক বাস্তবতায় নানা প্রতিবন্ধকতায় আটকে আছে।

প্রথমেই সমাজ বাস্তবতার প্রশ্ন আসে। বাংলাদেশ একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ। এখানে পরিবারিক সিদ্ধান্তে এখনো পুরুষের আধিপত্য প্রবল। মেয়েরা পড়াশোনা করবে নাকি অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবেÑ সিদ্ধান্তটা অনেক ক্ষেত্রেই মায়ের হাতে থাকে না, থাকে বাবার, কিংবা পরিবারের প্রবীণ পুরুষ সদস্যদের হাতে। আবার অর্থনৈতিক অনটনের চাপ যখন আসে, তখন মেয়েদের পড়াশোনার খরচকে ‘অতিরিক্ত’ বা ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করে অনেক পরিবার। এ কারণে শহরের আলো ঝলমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের নাম লেখানো গেলেও, গ্রামীণ প্রান্তে সেই সংখ্যাটা কমে আসে।

এখন আসি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নারী শিক্ষার সম্পর্কের কথায়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের দিকে তাকালেই বোঝা যায়Ñ শিক্ষিত নারীকর্মীর সংখ্যা যত বেশি, তত বেশি উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা। শুধু পোশাকশিল্প নয়, ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাÑসবখানেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু যারা সামান্য প্রাথমিক শিক্ষাও পাননি, তারা এই প্রতিযোগিতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। নারী শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলে দারিদ্র্য চক্র ভাঙে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের উত্তরাধিকার ঠেকানো যায়। এ কারণেই উন্নয়ন গবেষকরা বলেনÑ একজন শিক্ষিত নারী মানে একটি শিক্ষিত পরিবার, আর শিক্ষিত পরিবার মানে একটি সমৃদ্ধ সমাজ।

নারী শিক্ষার প্রভাব শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক ও নৈতিক পরিম-লেও এর গভীর প্রভাব রয়েছে। একটি শিক্ষিত নারী জানেন কোনটা অধিকার, কোনটা বৈষম্য। তিনি জানেন যৌতুক শুধু আর্থিক বোঝা নয়, এটি সামাজিক ব্যাধি। তিনি জানেন বাল্যবিবাহ মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। ফলে শিক্ষিত নারীরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, চারপাশের সমাজকেও সচেতন করেন। গ্রামের কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন একজন মেয়ে শিক্ষক পড়ান, তখন তিনি কেবল পাঠ্যবই পড়ান নাÑতিনি স্থানীয় কিশোরীদের সামনে এক প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। এই প্রতীকী শক্তিই সমাজ পরিবর্তনের প্রথম ধাপ।

কিন্তু চ্যালেঞ্জ কি কম? একেবারেই নয়। আজও বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে কিশোরীদের ঝরেপড়ার হার আশঙ্কাজনক। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বহু মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। বাল্যবিবাহ রোধে আইন থাকলেও বাস্তবতায় পরিবারগুলো নানা অজুহাতে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। শিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আবার যারা উচ্চশিক্ষায় যেতে চান, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, হয়রানি কিংবা পরিবহন সংকট বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখলে বোঝা যায়Ñ যেসব দেশ নারী শিক্ষায় জোর দিয়েছে, তারা অল্প সময়েই বিস্ময়কর উন্নয়ন অর্জন করেছে। কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ার উদাহরণ সামনে আছে। আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নারী শিক্ষায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। আজ দেশটি আফ্রিকার অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। অন্যদিকে, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে যেখানে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এখনো সীমিত, সেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে আছে। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়নযাত্রাকে স্থায়ী করতে চায়, তবে নারী শিক্ষাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার না দিয়ে কোনো উপায় নেই।

এখন প্রশ্ন আসেÑ নারী শিক্ষায় বিনিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট কি? সরকারের নানা প্রকল্প যেমন উপবৃত্তি কর্মসূচি, বিনা মূল্যে বই বিতরণ, মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রণোদনা ইত্যাদি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু এগুলো প্রাথমিক সহায়তা। আসল কাজ হলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। শুধু স্কুলে ভর্তি করলেই হবে না, সেই স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক, অবকাঠামো, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি এবং সামাজিক সহায়তা থাকতে হবে। বিশেষত গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শহরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন মেয়েরা আধুনিক শিক্ষা পাচ্ছে, তখন গ্রামে অনেক মেয়ে এখনো মাসিক চক্রের সমস্যায় ভুগে ক্লাস করতে পারে নাÑএটাই বৈষম্যের বাস্তব ছবি।

নারী শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একটি বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেইÑতা হলো নারীর আত্মমর্যাদা। একজন শিক্ষিত নারী শুধু অর্থ উপার্জন করেন না, তিনি আত্মসম্মান বোধ তৈরি করেন। তিনি সন্তানদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেন, তিনি পরিবারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতৃত্ব দেন। এক কথায়, তিনি সমাজের ভেতর এক ধরনের মেরুদ- হয়ে দাঁড়ান। আর রাষ্ট্রে মেরুদ- শক্তিশালী হলে সেটি কখনো ভেঙে পড়ে না।

আমাদের দেশে প্রায়ই নারী শিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা শোনা যায়, স্লোগান শোনা যায়, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে ঘাটতি রয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও, তারা গবেষণা কিংবা প্রযুক্তি খাতে পর্যাপ্ত সুযোগ পান না। আবার যেসব মেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করতে চান, তারা সামাজিক ভীতি কিংবা অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজÑতিন পক্ষকেই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারকে মেয়ে সন্তানের শিক্ষাকে সমান মূল্য দিতে হবে, রাষ্ট্রকে নিরাপদ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, আর সমাজকে নারী শিক্ষাকে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

আজকের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে শুধু শ্রমনির্ভর অর্থনীতি দিয়ে নয়, জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির পথে হাঁটতে হবে। জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন। আর এই তিন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া সামগ্রিক সাফল্য সম্ভব নয়। মেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল থেকেই তাদের মধ্যে গবেষণামুখী মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

সবশেষে বলা যায়Ñ নারী শিক্ষা কোনো দয়া নয়, কোনো অনুদান নয়; এটি একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সমাজের কর্তব্য এবং পরিবারের নৈতিক বাধ্যবাধকতা। যদি আমরা সত্যিই একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাই, তবে নারী শিক্ষার গুরুত্বকে কথার স্তরে নয়, বাস্তব প্রয়োগে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!