ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হাঁটু বা কোমর পানিতে ডুবে যায়, ব্যাহত হয় যান চলাচল, বিপর্যস্ত হয় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রাজধানীর ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ-ব্যবস্থা আধুনিকায়ন না হওয়া নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। বিশেষজ্ঞরা এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সমন্বয়হীন উন্নয়নকাজকে। ঢাকার চারপাশে একসময় অসংখ্য খাল, বিল ও জলাশয় ছিল, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে পানি নিষ্কাশনে ভূমিকা রাখত। কিন্তু দখল, ভরাট ও অব্যবস্থাপনার কারণে সেই সব জলাধার আজ প্রায় বিলুপ্ত। ফলে বৃষ্টির পানি নামার কোনো প্রাকৃতিক পথ আর অবশিষ্ট নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিক, পলিথিন ও আবর্জনায় ভরা নালা, যা কয়েক মাস পরপর পরিষ্কার করলেও পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে যায়। অর্থাৎ, মূল সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়, কেবল সাময়িক সমাধানেই সীমাবদ্ধ থাকছে সিটি কর্তৃপক্ষ। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু গত চার বছরে দুই সিটি করপোরেশন খাল ও নালা সংস্কারে ব্যয় করেছে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।
খাল পুনর্খনন, ড্রেন নির্মাণ কিংবা পাম্প বসানোর নানা প্রকল্পের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সমস্যাটি হচ্ছে দুর্বল নকশা, অনিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সমন্বয়ের অভাব। একদিকে রাস্তা নির্মাণ, অন্যদিকে ড্রেন খনন! এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকা-ের কারণে সমস্যার সমাধান তো হয়ইনি, বরং দিনে দিনে আরও জটিল হয়েছে। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। রাজধানীর প্রতিটি খাল ও নালার বিস্তারিত সমীক্ষা করে কোথায় পানি আটকে থাকে এবং কেন থাকে, তার সুনির্দিষ্ট মানচিত্র তৈরি করা জরুরি। শুধু খাল খনন নয়, সেগুলো দখলমুক্ত রেখে সংরক্ষণ করাও প্রয়োজন। আইন প্রয়োগ করে দখলদারদের উচ্ছেদ ও জলাধার পুনরুদ্ধারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
একই সঙ্গে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। নগরবাসী এখনো নির্বিচারে নালা ও খালে প্লাস্টিক, পলিথিন ফেলছে; যা পানি নিষ্কাশনের প্রধান অন্তরায়। তাই প্লাস্টিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্পেইন চালাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা জরুরি। উন্নয়নকাজের সমন্বয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানীতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রাস্তা খোঁড়া হয়, আবার কিছুদিন পরেই সেই একই জায়গায় পানি সরবরাহ বা ড্রেনেজ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই সমন্বয়হীন কর্মকা-ের ফলে সমস্যা বেড়েই চলেছে। তাই ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান জরুরি। অন্যথায় খ-িত উদ্যোগ কখনোই টেকসই সমাধান দিতে পারবে না। এর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী সমাধান গ্রহণ করাও জরুরি। বিশ্বের অনেক শহরে ভূগর্ভস্থ রিজার্ভার, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এবং আধুনিক স্ট্রম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা মোকাবিলা করা হচ্ছে। ঢাকাকেও সেই পথে হাঁটতে হবে।
বিশেষ করে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও কংক্রিটের আধিক্যের কারণে এখানে বর্ষার পানি ভূগর্ভে নামতে পারে না। তাই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রযুক্তিগত সমাধান গ্রহণ না করলে সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না। এ ছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। নাগরিকদের করের টাকা ব্যয় করে যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিশ্চিত না করলে জলাবদ্ধতা শুধু ভোগান্তি নয়, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে। নগরবাসীর প্রতি কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। ঢাকা বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র।
অথচ মাত্র দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে যখন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রাজধানীর প্রধান সড়ক হাঁটু ও কোমরপানিতে ডুবে যায়, তখন কেবল নগরবাসী নয়, দেশের ভাবমূর্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে রাজধানীকে আধুনিক, টেকসই ও বাসযোগ্য করে তুলতেই হবে।
স্থায়ী সমাধান হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে, দখলকৃত জলাধার উদ্ধার করতে হবে, কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে এবং সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় ঢাকার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না কখনোই। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য ঢাকার জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার আগেই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।