সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মালিহা মেহনাজ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

শিশুশ্রম থেকে মানবপাচার, দাসপ্রথার আধুনিক রূপ

মালিহা মেহনাজ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

শিশুশ্রম থেকে মানবপাচার, দাসপ্রথার আধুনিক রূপ

মানব সভ্যতার ইতিহাস যত পুরোনো, দাসপ্রথার অস্তিত্ব ঠিক ততটাই প্রাচীন। মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ, বিজয় ও শোষণের মাধ্যমে দাসপ্রথা এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে জায়গা করে নেয়। আরব বণিকদের মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে দাস ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন। ধীরে ধীরে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে দাসপ্রথা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। এটি আজও টিকে আছে নতুন রূপে। যাকে আমরা আধুনিক দাসপ্রথা বলে জানি। 

আধুনিক দাসপ্রথা মূলত মানবপাচার, শিশুশ্রম, জোরপূর্বক শ্রম, জোর করে বিয়ে দেওয়া কিংবা যৌন শোষণের মাধ্যমে চর্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাসপ্রথার ইতিহাসও বহু পুরোনো। প্রাচীন বাংলায় যুদ্ধবন্দি কিংবা ঋণগ্রস্তদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আজ আমরা যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির যুগে বাস করছি, তখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে দাসপ্রথা একেবারে বিলুপ্ত হয়নি বরং নতুন রূপে আবারও ফিরে এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় দাসপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হলেও এর আধুনিক রূপ আজও বিরাজমান। এবার আর শেকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে বাজারে দাঁড় করানো না। অর্থনৈতিক বঞ্চনা, সামাজিক বৈষম্য, অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের মাধ্যমে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আধুনিক দাসত্বে। শিশুশ্রম থেকে মানবপাচার সবই এই অদৃশ্য শিকলের প্রকাশ। যা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার সংকটগুলোর মধ্যে একটি।

শিশুশ্রম হলো আধুনিক দাসপ্রথার সবচেয়ে ভয়াবহ ও দৃশ্যমান রূপ। গার্মেন্টস শিল্প, ইটভাটা, ট্যানারি কিংবা গৃহস্থালির কাজে হাজার হাজার শিশু দাসের মতো দিনরাত কাজ করছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি শিশু আজও শ্রমে নিযুক্ত। এর মধ্যে কয়েক কোটি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত, যেখানে তাদের জীবনযাত্রা ও ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে। গার্মেন্টস কারখানা, ইটভাটা, ট্যানারি, চা বাগান কিংবা বাসাবাড়ির গৃহস্থালি কাজ; সব জায়গায় শিশুরা শ্রমশক্তি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। যেই হাত খেলার মাঠ কিংবা বইয়ের পাতায় থাকার কথা, তারা আজ ব্যস্ত থাকে হাতুড়ি, কাস্তে বা সুচ-সুতা নিয়ে। মজুরি সামান্য, কাজ দীর্ঘ, আর সুরক্ষা প্রায় অনিশ্চিত। একদিকে পরিবারকে খাবার জোগানোর দায়, অন্যদিকে সমাজের উদাসীনতা। সব মিলিয়ে শিশুরা যেন জন্মের পর থেকেই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।

মানবপাচার আধুনিক দাসত্বের আরেক ভয়াবহ রূপ, যা শিশুশ্রমের সঙ্গেও জড়িত। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ পাচারের শিকার হচ্ছে যার মধ্যে নারীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দরিদ্র পরিবার সহজেই পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া কিংবা ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেক মানুষ অবৈধ দালালের হাতে পড়ে দাসের মতো কাজ করতে বাধ্য হয়। বিদেশে ভালো চাকরি, উন্নত জীবন কিংবা স্থায়ী বসবাস এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে অসংখ্য ছেলে-মেয়ে কে পাঠানো হয় অচেনা দেশে। তাই, আধুনিক দাসপ্রথা আর কোনো দূর দেশের সমস্যা নয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা এক অদৃশ্য দানব।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, আধুনিক দাসত্ব অনেক সময় বৈধ কাজের আবরণে লুকিয়ে থাকে। যেমন, অভিবাসী শ্রমিকদের কাগজে-কলমে বৈধ চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তাদের অতিরিক্ত কাজ করানো হয়, ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না, চলাফেরার স্বাধীনতাটুকুও দেওয়া হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ২৮ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক শ্রমে আবদ্ধ, আর ২২ মিলিয়নের বেশি নারী জোর করে বিয়ে দেওয়া অবস্থায় আছে। এটি দাসপ্রথার এমন রূপ, যেখানে মানুষ নিজের শরীর ও সিদ্ধান্তের ওপর কোনো অধিকার রাখে না।

এ পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম ও মানবপাচারকে কেবল অর্থনৈতিক সংকট হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি আসলে একটি সামাজিক ও নৈতিক সংকট। যখন কোনো শিশু শিক্ষার সুযোগ হারায়, তখন কেবল তার ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নয়, গোটা সমাজের অগ্রগতি বাঁধার মুখে পরে। একজন নির্যাতিত নারী বা জোরপূর্বক শ্রমিক যখন নিজের মর্যাদা হারায়, তখন মানবতার মূল ভিত্তিই ভেঙে পড়ে। আধুনিক দাসপ্রথা তাই কেবল একটি পরিসংখ্যান নয় এটি আমাদের সমাজের মানবিকতার মেরুদ-ে আঘাত হানা এক ভয়াবহ বাস্তবতা। এর পেছনের মূল কারণগুলো স্পষ্ট। দারিদ্র্য একটি শিশুকে শ্রমে পাঠাতে বাধ্য করে। অশিক্ষা পরিবারকে বুঝতে দেয় না যে শিশুশ্রম কোনো সমাধান নয়। বৈষম্য ও লোভ মানুষকে পাচারকারীর ফাঁদে ফেলে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের ভোগবাদী সমাজ সস্তা শ্রমের জন্য আধুনিক দাসত্বকে উৎসাহিত করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ন্যায্য মজুরি না দিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে চায়, আর ভোক্তারা সস্তা পণ্য কিনে অজান্তেই সেই শোষণকে টিকিয়ে রাখে। এভাবে বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবাহ দাসপ্রথাকে বিলীন না করে বরং আরও বৈধতা দিচ্ছে।

দাসপ্রথার আধুনিক রূপ থেকে বের হতে হলে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগ অপরিহার্য। পাচারকারী চক্র ও শিশুশ্রম ব্যবহারকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও পরিবারগুলোকে বিকল্প আয়ের সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য না হয়। শিক্ষা হলো মুক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। প্রতিটি শিশুর জন্য বিনা মূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে শিশুশ্রম অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা পাচারকারীর প্রলোভনে না পড়ে। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নও অত্যন্ত জরুরি কারণ পাচারের শিকারদের একটি বড় অংশ হলো নারী। সমাজে নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পাচারের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে। পাচার ও জোরপূর্বক শ্রম কোনো এক দেশের সমস্যা নয় বরং বৈশ্বিক সংকট। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় গন্তব্য ও উৎস দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে হবে যেন তারা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নৈতিক মান বজায় রাখে। আর ভোক্তারাও তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে ন্যায্য বাণিজ্যের পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে।

আধুনিক দাসপ্রথা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে অথচ আমরা অনেক সময় তা দেখতে পাই না বা দেখতে চাই না। শিশুশ্রমিকের ঘামে ভেজা পোশাক পরে যখন আমরা গর্ব করি, তখন হয়তো আমরা ভুলে যাই এর পেছনে আছে এক শিশুর হারানো শৈশব। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের রেমিট্যান্সে যখন আমরা অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার গল্প শুনি তখন হয়তো চাপা পড়ে যায় সেই শ্রমিকের বঞ্চনার কথা। এই অদৃশ্য শৃঙ্খল ভাঙতে হলে দরকার সচেতনতা, দায়বদ্ধতা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ‘শিশুশ্রম থেকে মানবপাচার’ এ সবকিছুই আমাদের সময়ের দাসপ্রথার আধুনিক রূপ। একে অস্বীকার করার সুযোগ নেই বরং প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আমাদের সবার। কারণ মানবিকতা যেখানে পরাজিত হয়, সেখানে সভ্যতার অগ্রগতিও অর্থহীন হয়ে পড়ে। দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল ভুক্তভোগীদের মুক্তির লড়াই নয়। এটি আমাদের সবার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

মালিহা মেহনাজ 
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!