ঢাকা শনিবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৫

ক্ষোভের বিকল্প ডিমই থাকবে?

রিন্টু আনোয়ার
প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ১২:৪২ এএম

রাজনৈতিক বোলচালে, দৃশ্যপটের আবডালে, স্বার্থ হাসিলে কোনো তুলকালাম কা- ঘটিয়ে ভিন্ন কিছু একটা ঘটানোর কৌশল দুনিয়া জোড়াই চলমান। আর সেখানে ডিম হলো একটা আইটেম। যত না খাওয়ার মেন্যু, তার চেয়ে বেশি ছোড়ার ম্যানু। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ডিম, টমেটো ও পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা নতুন নয়।

হাঁস বা মুরগির ডিম খাওয়ার টেবিলের একটি সাধারণ খাবার হলেও রাজনীতি ও প্রতিবাদের মঞ্চে প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে এটি একটি অস্ত্র। ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, নানা সময় ভিন্ন ভিন্ন কারণে রাজনীতিবিদদের দিকে ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মানুষ ডিম ছুড়ে মেরেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ডিম ছোড়ার প্রবণতা বেড়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে শাস্তিমূলক নীতিতে ক্ষুব্ধ প্রজারা শালগম ছুড়ে মেরেছিল।

যদিও মধ্যযুগে ডিম প্রবেশ করে এ তালিকায়। তখন বন্দিদের প্রকাশ্যে একসঙ্গে বেঁধে ডিম ছুড়ে মারা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এলিজাবেথীয় যুগে নাট্যমঞ্চে খারাপ অভিনয়ের প্রতিবাদে দর্শকরা পচা ডিম ছুড়ত, যা আজকের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে ব্যবহারের সঙ্গে খুব একটা বেমানান মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ডিম ছোড়ার প্রবণতা বেড়েছে। হাঁস বা মুরগির ডিমকে অনেকে রসিকতা করে ব্যাচেলর ফুড নামে ডাকে।  অথচ পুষ্টিগুণে ভরপুর এ ডিমকে ছুড়ে মেরে পুষ্টিটি বরবাদ করা হয় অহরহ। হাঁস বা মুরগির ডিম খাওয়ার টেবিলের একটি সাধারণ খাবার হলেও রাজনীতি ও প্রতিবাদের মঞ্চে প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে এটির বেশ পরিচিতি রয়েছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, নানা সময় ভিন্ন ভিন্ন কারণে রাজনীতিবিদদের দিকে ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মানুষ ডিম ছুড়ে মেরেছে। ডিম নিক্ষেপে মাথা ফাটার সম্ভাবনা কম থাকে, সহজে ফেটে যায় এবং ঠাস করে ছোট্ট একটি শব্দ হয় ও রস বের হয়। যে ছুড়ে মারে সে আনন্দ পায়। যাকে ছুড়ে মারা হয় তিনি বিব্রতবোধ করেন। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ডিম ছোড়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়।

এরই ধারাবাহিকতায় ডিম মারার প্রচলন বাংলাদেশের আদালত চত্বর থেকে অতিসম্প্রতি সুদূর নিউইয়র্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এনসিপি নেতা আক্তার হোসেনকে মারার মধ্যে দিয়ে। ডিম নিক্ষেপণ সংস্কৃতির অবসান চেয়েছেন জামায়াত নেতা ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। দেশের বাইরে নিউইয়র্কে এসে ওনার এই উপলব্ধি একটি ঘটনা। বাস্তবতা হলো এত প্ল্যান করেও নিউইয়র্কে ডিম ঠেকানো গেল না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাকে ঘিরে প্রতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে বসে বাংলাদেশি সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে দলীয়পনার হাটবাজার। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা নিউইয়র্কে জড়ো হন। প্রাক মহড়া হিসেবে জ্যাকসন হাইটসে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল-মিটিং, হাতাহাতি-মারামারি। কাটাকাটিও হয়? না, তা এখনো না হলেও ডিমকা- আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ সেখানে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের দেশের সমস্যা নিয়ে হাজির হন। দেশের পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে মানববন্ধন করেন। আমরা হলাম বিপরীত। ডিমের শিকার এনসিপি নেতা আখতার হোসেন বলেছেন, এতে তিনি ভয় পাননি। যেমন ভয় পাননি শেখ হাসিনার বুলেট-বোমাকে।  ডিম ছোড়া দুনিয়া জোড়া চলে আসছে বহুকাল ধরে।

রাজনীতিতে এমন সংস্কৃতি এলো কোথা থেকে? দ্য গার্ডিয়ান, কনভারসেশন ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন ঘেটে জানা গেল, প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে খাবার ছুড়ে মারার ইতিহাস বহু আগের। ৬৩ খ্রিষ্টাব্দে খাবারের অভাবের কারণে ‘হাডুরুমেটুম’য়ের অধিবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে মুলা ছুড়ে মেরেছিলেন আফ্রিকার তখনকার গভর্নর ভেসাপাসিয়ানকে। পরে তিনি রোমান সম্রাট হন। কথিত আছে, মধ্যযুগে বন্দিদের জড়ো করে শাস্তি হিসেবে তাদের ওপর ডিম মারা হতো। তবে লিখিতভাবে ডিম নিক্ষেপের কাহিনি পাওয়া যায় ১৮শ’ সালের দিকে। সেই সময় ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপাঞ্চল ‘আয়েল অফ ম্যান’য়ে মেথোডিস্ট’দের ওপর ডিম ছোড়া হয়। আর ১৮৩৪ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ারের  কনকোর্ডে মার্কিন কবি জর্জ হোয়াইটার দাসত্ববিরোধী বক্তৃতা দেওয়ার সময়, তাকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়। এ ছাড়াও ডিমের শিকার হয়েছিলেন হলিউড অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারও। ২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর ভোটের প্রচারণা চালানো সময় তার দিকে ডিম ছোড়া হয়। অবশ্য তিনি সিনেমার নায়কের মতোই নির্বিকারভাবে হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেন ভাঙ্গা ডিমের অংশবিশেষ। ২০০৪ সালে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ফেডোরোভিচ ইয়ানুকোভিচকে বিরোধীদের ছোড়া ডিমে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। ২০১১ সালে আফগানি বিক্ষোভকারীরা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ইরানি কন্স্যুলেটদের দিকে ডিম ছোড়ার ঘটনা মুছে যায়নি।

২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লসের ওপর ডিম ছোড়ায় অভিযুক্তকে আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজকে এক জনসভায় ডিম ছুড়ে আঘাত করা হয়েছিল। ব্রিটেনে ২০০১ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকটকে একজন তরুণ কৃষক ডিম ছুড়লে প্রেসকট নিজেই ঘুষি মেরে প্রতিক্রিয়া দেখান। মুহূর্তটির ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ১৭ বছর বয়সি উইল কনলি, যিনি ‘এগ বয়’ নামে পরিচিত, বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়া সেনেটর ফ্রেইজার এনিংয়ের মাথায় ডিম ছোড়েন। ওই ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। কনলির প্রতি অনেকেই সমর্থন প্রকাশ করে, এমনকি অনুদানও তোলা হয়। ডিম ছোড়ার পেছনে রয়েছে আরও দীর্ঘ ইতিহাস। কথিত আছে, মধ্যযুগে বন্দিদের জড়ো করে শাস্তি হিসেবে তাদের ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হতো। তবে লিখিতভাবে ডিম নিক্ষেপের কাহিনি পাওয়া যায় ১৮শ’ সালের দিকে। সেই সময় ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপাঞ্চল ‘আয়েল অফ ম্যান’য়ে মেথোডিস্ট’দের ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে।

আর ১৮৩৪ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ার’য়ের কনকোর্ড’য়ে মার্কিন কবি জর্জ হোয়াইটার দাসত্ববিরোধী বক্তৃতা দেওয়ার সময়, তাকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়। দেশজুড়ে কনস্যক্রিপশন বিরোধী আন্দোলনের উত্তাপেই সেই ঘটনা ঘটে, যা পরে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিতর্ককে ঘনীভূত করে। ২০১৩ সালে লন্ডনে একদল বিক্ষোভকারী, প্রয়াত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কফিন ডিম দিয়ে পরিপূর্ণ করার হুমকি দেয়। যদিও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়াতে চরম নিরাপত্তার কারণে সেটা তারা করতে পারেনি। একই বছর আগস্টে ডিমের দাম কমে যাওয়ার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ফরাসি কৃষকরা রাস্তায় সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন ১ লাখ ডিম ভাঙার শপথ নিয়েছিল। শপথ অনুযায়ী সেই শপথ বাস্তবায়ন চলে কয়েকদিন।

যাক হোক, বিশ্বে ইউরোপসহ আরও অনেক দেশে এই ‘ডিম ছোড়া’ আছে বলে তা চলতেই থাকবে?

বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বিচারাধীন বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-নেতাদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানে কিছুদিন আগে ডিম ছুড়ে মারেন বিভিন্ন আইনজীবী সদস্যরা।

জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আখতারের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাটি কোনো হালকা ঘটনা নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ফৌজদারি আইন অনুযায়ী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য জেলও হতে পারে, শারীরিক আঘাত হলে শাস্তি আরও কঠিন হয়। জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনালি প্রোটেক্টেড পারসনস, ইনক্লুডিং ডিপ্লোমেটিক এজেন্টস, ১৯৭৩ অনুযায়ী, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত কোনো ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালালে, হুমকি দিলে হামলায় সহযোগিতা বা অংশ নিলে প্রতিটি দেশকে তাদের নিজস্ব আইনে একে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। বাস্তবে নিউইয়র্কে এ অপরাধটা গুরুতর নয়। সাধারণত এসব অপরাধে প্রবেশনমূলক শাস্তি হয়ে থাকে এবং মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অঙ্গীকার নেওয়া হয় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ আর করবেন না। যুবলীগ নেতা তা-ই করেছেন। এ ছাড়া,  মৌখিকভাবে যা-ই বলা হোক, তাকে অপরাধ হিসেবে প্রমাণ করা যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কঠিন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে সেই সুযোগটাই নিয়েছেন।

যাই হোক, ডিমের দামের হিসাব দিয়ে শেষ করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৮ দশমিক ৫০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ হাজার ৩৪ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ে প্রায় ৮৬ টাকা। আর বাংলাদেশে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে যাওয়া এই ডিম এখন সাড়ে ১২ টাকা মূল্যে কিনতে হয়। এটি আমাদের রাজনৈতিক ক্ষতের গভীরতা প্রকাশ করছে।

রিন্টু আনোয়ার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট