জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব যে ধ্বংসস্তূপের মুখোমুখি হয়, তার ভয়াবহতা দেখে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব যেন এমন কিছুর দ্বারপ্রান্তে না যায়, সে জন্য প্রথমে ৫০টি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে জাতিসংঘকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে সবশেষ বিশ্বের প্রায় সব স্বাধীন দেশ (১৯৩) যোগ দেয়।
জাতিসংঘকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি না হতে হয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলাই যায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোই আজ বিশ্ব মানবাধিকার সুরক্ষার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। বিশেষ করে ভেটো ক্ষমতা নামক একটি অস্বাভাবিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করছে। ভেটো দিতে পারার দেশ গুলো নিজের স্বার্থ পরিপন্থি যেকোনো প্রস্তাব ভেটো দিয়ে বাতিল করে যেকোনো দেশকে গাজার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পিছপা হবে না।
বর্তমান গাজা সংকট এ সত্যকে আরও স্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করছে। ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে নিহত হচ্ছে, হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস করা হচ্ছে, লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে গণহত্যা বলে অভিহিত করছে। কেউ কেউ একে জাতি নিধন বলেও অভিহিত করছে। কিন্তু বিশ্বের শীর্ষ কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ মানবিক বিপর্যয় থামানোর কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নিতে না পারার একমাত্র কারণ ভেটো ক্ষমতা। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যথা- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন; প্রত্যেকের হাতে রয়েছে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা। অর্থাৎ, বিশ্বের যেকোনো ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ পাঁচ দেশের কোনো একটির অস্বীকৃতি মানেই পুরো প্রস্তাব বাতিল। একটি দেশের স্বার্থ কোটি কোটি মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দেখা দিচ্ছে গাজার মতো ভয়ংকর মানবিক সংকট।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত ৯ বার গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতিসংক্রান্ত প্রস্তাব আনা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রই পাঁচবার ভেটো দিয়ে পাঁচটি প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। এখানেই স্পষ্ট, ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ভেটো দিয়ে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় বানচাল করেই যাচ্ছে দেশটি।
গাজার ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় প্রায় প্রতিটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কিংবা নিন্দা প্রস্তাবকে ভেটো দিয়ে বাতিল করেছে। ফলে গাজায় রক্তপাত চলছেই, আর বিশ্ব অসহায়ভাবে তাকিয়েই আছে। এমনকি সেই যুক্ত রাষ্ট্রকেই প্রভু হিসেবেই মানছে। বিশ্ববিবেকের কি ভয়ংকর অধঃপতন!
জাতিসংঘের আসল উদ্দেশ্য কি মানবাধিকার রক্ষা, নাকি পরাশক্তিদের স্বার্থ রক্ষা? যদি মানবাধিকারই মুখ্য হতো, তবে এত দিনে গাজার মানবিক সংকট উত্তরণ সম্ভব হতো। কিন্তু ভেটো ক্ষমতার কারণে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায্যতা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। গাজার শিশুর কান্না কিংবা মায়ের আর্তনাদ ভেটোর প্রাচীরে আটকে যাচ্ছে।
গাজার সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান কাঠামো কতটা অমানবিক। ভেটো ব্যবস্থার ফলে একটি রাষ্ট্র নিজের রাজনৈতিক ও সামরিক মিত্রকে রক্ষা করার জন্য গোটা বিশ্বের মানবিক দাবি অগ্রাহ্য করতে পারে। ইতিহাসে আমরা বারবার এ দৃশ্য দেখেছি। সিরিয়া সংকটে রাশিয়া বহুবার ভেটো প্রয়োগ করেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ক্ষেত্রেও চীন ও রাশিয়া প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো এখন এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এভাবে ভেটো মানবাধিকার সুরক্ষার পরিবর্তে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেখা যাচ্ছে রক্ষকই আজ ভক্ষকরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। কিন্তু তাকে মোকাবিলা করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নির্জীব ভূমিকা পালন করছে।
ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনই বাড়াচ্ছে না, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করছে। জাতিসংঘ সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, মানবাধিকার সুরক্ষা জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু সনদটি কেবল পলিসি, বাস্তবে তা কিছু দেশের স্বার্থ রক্ষা করছে। যদি একটি দেশ তার মিত্রের অপরাধ ঢাকতে ভেটো প্রয়োগ করতে পারে, তবে আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক আদালত এসব ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই না। গাজার মানুষ আজ এ দ্বিমুখী নীতির সবচেয়ে বড় শিকার।
এ অবস্থায় প্রয়োজন একটি বাস্তবসম্মত সংস্কার। ভেটোব্যবস্থাকে হয় সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে, নয়তো মানবাধিকার ও গণহত্যার মতো ইস্যুতে ভেটো নিষিদ্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কয়েকটি দেশের স্বার্থের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে না। এমন একটি ব্যবস্থা সভ্য সমাজে চলতে দেওয়া যায় না। জাতিসংঘ যদি সত্যিই মানবিক প্ল্যাটফর্ম হতে চায়, তবে তাকে তার কাঠামোগত বৈষম্য দূর করতে হবে। নইলে গাজার মতো মানবিক বিপর্যয় বারবার ঘটবে এবং জাতিসংঘ কেবল বিবৃতি প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকবে।
হুমায়ুন আহমেদ নাইম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়