বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর কেবল আদর্শ ও কর্মসূচির প্রতিযোগিতা নয়। এ যেন শব্দের যুদ্ধক্ষেত্র। কথার পিঠে কথা নয়, অশ্লীল অশ্রাব্য শব্দের পসরা। রাজনীতির মঞ্চ থেকে আজ ভেসে আসে অশালীন বাক্য, হুমকি, কটূক্তি, এমনকি ব্যঙ্গের ছুরি। যারা একসময় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন, আজ তাদের মুখেই শোনা যায় বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা ও বিভাজনের ভাষা। ফলে রাজনীতি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে, মানুষ হারাচ্ছে আস্থা। আগামী প্রজন্ম কি এতে সম্মতি দেবে? প্রশ্ন থেকে যায়। উত্তর মিলিয়ে নিতে হবে নিজেকে।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘নো হাঙ্কি পাঙ্কি। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব। তবুও ঘি আমার লাগবেই লাগবে।’ এই উক্তি শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক ধরনের হুমকি নয়। এটা নৈতিক পরিসরেও গভীর আঘাত। ধর্মীয় চর্চার দাবিদার একটা দলের ও রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বহনকারী একজন নেতার মুখে এমন অশোভন তুলনা রাজনীতির ভাষাকে একেবারে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। হয়েছেন সমালোচিত।
একইভাবে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর ওসমান হাদীর প্রকাশ্য গালাগাল রাজনীতির সভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছে। যে আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবিতে জন্ম নিয়েছিল, সেটি এখন নেতার ব্যক্তিগত রাগ-ক্ষোভের প্রকাশের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। তার বক্তব্যে ছিল না যুক্তি, না ছিল মানবিক আবেদন; বরং সেখানে ছিল কেবল তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষের মাত্রা এতই প্রকট যে, মানুষও বুঝতে শুরু করেছে কতিপয় এসব নেতার আদর্শ ও উদ্দেশ্য। তবে আরও কিছুদিন অপেক্ষায় হয়তো স্পষ্ট হতে শুরু করবে এরা আদতে কি চায়? এসব অশালীন ভাষা প্রয়োগ তাদের ব্যক্তিত্বের অবস্থান জানান দিতে যথেষ্ট। কারণ ইতিপূর্বে হাদী বলেছেন, ’৭১-এর বিরুদ্ধেই ’২৪-এর অভ্যুত্থান! তার কথাটিও ইঙ্গিতবহ। তবে ’৭১ ভোলানো কতটা সহজ তা হয়তো বুঝতে এদেরও সময় লাগবে! কারণ বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ’৭১ নিছকই সংখ্যা নয়। এটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত। অথচ ’২৪-এর অভ্যুত্থান পরবর্তী বৈষম্য আরও জেঁকে বসেছে। তাহলে কি যুগে যুগে রাজনীতির ক্রীড়ানকই হবে আপামর জনতা?
অন্যদিকে, বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর মুখ্য সমন্বয়কারী নাসির উদ্দীন পাটওয়ারী ও হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তৃতাও উদ্বেগজনক। তারা বারবার এমন শব্দচয়ন করেছেন যা কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই অসম্মানিত করে। রাজনীতির নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা যদি এ ধরনের ভাষাকে ‘কৌশল’ মনে করেন, তাহলে তা ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক বার্তা। কারণ এমন করেই একদিন তাদের রুখে দিতেও প্রজন্ম দেরি করবে না। কারণ তারা কি কেবলই ছাত্র? নাকি ছাত্রনেতা? নাকি জাতীয় নেতা হয়ে উঠছেন? আদতে তা পরিষ্কার হবে আসন্ন নির্বাচনে জনগণ তাদের কতটুকু গ্রহণ করছে, তা দেখে।
রাজনীতির ভাষা কেবল শব্দের খেলা নয়। এটা সমাজের নৈতিকতার প্রতিফলন। একজন নেতা যখন বক্তব্য দেন, তিনি আসলে তার চরিত্র, দলীয় সংস্কৃতি, এবং রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন। সেই বক্তব্য যদি হয় কটু, আক্রমণাত্মক, বা বিদ্বেষপূর্ণÑ তাহলে তা শুধু প্রতিপক্ষ নয়, গোটা জাতির মানসিকতাকেই কলুষিত করে। এর বেশি আর কিই বা বলা যেতে পারে!
‘সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব’Ñ এই উক্তি রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার মৃত্যুঘণ্টা। এটি শুধু হুমকিই নয়, সহিংসতার নৈতিক অনুমোদনও বটে। আর যখন এ ভাষা ধর্ম বা আন্দোলনের আবরণে প্রচারিত হয়, তখন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়Ñ কারণ তারা ভাবতে থাকে, রাজনীতি কি সত্যিই জনসেবার পথ, নাকি ভয়ের রাজনীতি? আর ভয় দিয়ে যে দেশ শাসন হয় না, পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংগ্রাম তারই প্রমাণ।
আজকের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, কারণ রাজনীতি মানে এখন গালাগাল, হুমকি, আর প্রতিহিংসা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও রাজনৈতিক সভাগুলোতে যুক্তি ও বিতর্কের জায়গা হারিয়ে ফেলেছে চিৎকার আর কটূক্তির ভাষা। যেখানে ছাত্র নামে ছাত্রনেতারা শিক্ষকদের প্রতি সীমাহীন অসম্মান প্রদর্শনকেই নিজেদের দাপট ভেবে যাচ্ছেতাই করে চলেছেন। তাতে কি হয় কেউ অসম্মানের ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। আর এতেই তথাকথিত ছাত্রনেতারা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবতে থাকেন। বেপরোয়া হয়ে পড়েন। ফলাফল হিসেবে জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের ঢ়ড়ষরঃরপধষ ধঢ়ধঃযু অর্থাৎ রাজনীতিবিমুখ সমাজ। যা কথিত ছাত্রনেতারা অনুধাবন করতেও সক্ষম নয় বোধকরি।
বেশ কিছুদিন ধরে শব্দবোমার জনক সেফুদাও কিছু লোকের কাছে জনপ্রিয়। আমার দেশের রাজনীতিকদের ভাবতে হবে তারা কি সেফুদার মতো জনপ্রিয় হবে! যে সেফুদা কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষের হাস্যরসের যোগান দেয়। অন্যদিকে দেশত্যাগী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন যাকে-তাকে যখন-তখন আক্রমণ করে অশ্লীল শব্দ দিয়ে। আর প্রবাসী এক্টিভিস্ট পিনাকীও একই ঢঙে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ, উসকানিমূলক বক্তব্যতে তার তথাকথিত ভক্তদের মাতিয়ে রেখেছে। ভিউ ব্যবসার আড়ালে এসবে কিছু নিচু মানসিকতার মানুষ আনন্দের উপাদান খুঁজে পায়।
রাজনীতি যে একসময় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করত, তা এখন মানুষকে বিভক্ত করছে। এক সময়ের প্রেরণাদায়ী বক্তৃতা আজ পরিণত হয়েছে বিদ্বেষের প্রচারণায়। যে রাজনীতির লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ, সেই রাজনীতি আজ যেন কেবল ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা।
রাজনীতির ভাষায় এ অবক্ষয়ের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ স্পষ্টভাবে দেখা যায়-
১. দ-মুক্তির সংস্কৃতি : অশালীন ভাষা ব্যবহার করেও নেতারা জবাবদিহির মুখে পড়েন না। বরং অনেকে মনে করেন, যত কড়া ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা যায়, তত জনপ্রিয় হওয়া যায়।
২. মিডিয়ার প্রণোদনা : টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র বা ‘ভাইরাল’ বক্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সংযম নয়, উত্তেজনাই হয়ে ওঠে প্রচারের হাতিয়ার।
৩. আদর্শচর্চার অভাব : বর্তমান রাজনীতিতে চিন্তাধারার জায়গা কমে গেছে। দলীয় শিক্ষা, রাজনৈতিক নীতি, কিংবা মানবিকতা শেখানোর উদ্যোগ প্রায় অনুপস্থিত।
৪. জনসমাজের সহনশীলতা হ্রাস : সমাজেও ক্রমে সহনশীলতার অবক্ষয় ঘটছে। মানুষ এখন অশ্রাব্যতাকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করছে। ফলে রাজনৈতিক ভাষার মানোন্নয়ন নিয়ে সামাজিক চাপও নেই।
আর অন্যদিকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মোজো রিপোর্টারদের জন্য এসব হটকেক সাংবাদিকতা নীতিমালার সঙ্গে ঠিক কতটুকু যাচ্ছে তা-ও আমার বোধগম্য হয় না। এসবও প্রচারের বিষয়? আফসোস আমরা তেমনই এক সংস্কৃতি বা সময়ের বাহক হতে চলেছি।
একটি সভ্য রাষ্ট্রে রাজনীতি মানেই প্রতিযোগিতা নয়, সহাবস্থান। বিরোধিতা থাকবে, কিন্তু সেটা হতে হবে যুক্তিনির্ভর ও পরিশীলিত। সংযম রাজনীতিকে দুর্বল করে না, বরং তাকে উচ্চে তুলে ধরে। আর এসবই যেন আমরা ভুলতে বসেছি। গত ১৫ মাসে রাজনীতিকদের কিংবা ছাত্র সংগঠন বা নামে-বেনামে ভুঁইফোড় সংগঠনের ব্যানার আর শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শনী দেখলে যে কারো মনে হতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নকামী রাষ্ট্র আর কবে জানান দেবে আমরা উন্নত। শুধু ধনে-জনে নয়। সভ্য-ভব্য আচরণে। যেখানে ভোট পেতে প্রতারণা প্রবঞ্চনা করে রোজা আর পূজাকে মিলিয়ে ভিন্নধর্মের লোকেদের মন জয় করার কৌশলের অপকৌশল সাদা চোখেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কার চাওয়া কি! এই চাওয়া কি সত্যিই পাওয়ার সমীকরণে এক সুতোয় বাঁধা সম্ভব? তারা কি সত্যিই বিষ্ণু, কৃষ্ণ, যিশু আর মোহাম্মদকে ভাবাদর্শ মেনে রাজনীতি করতে চান? নাকি মুখের কথা আর অন্তরের ফারাক আছে। যা বিরোধীদের ভাষ্যে মোনাফেকি! না হলে জামায়াতপন্থি আইনবিদ শিশির মনির কেন বলবেন!
পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ভাষার পরিশীলনই রাজনীতির সংস্কৃতি নির্ধারণ করে। পার্লামেন্টে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতের সংসদীয় বিতর্কে তীব্র মতভেদ দেখা গেলেও, বক্তৃতায় এক ধরনের শালীনতা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি সেই সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। আমরা কি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখব?
যখন রাজনীতিবিদরা ভাষায় সংযম হারান, তখন নাগরিকরা রাজনীতিতে আগ্রহ হারান। গণতন্ত্র তখন জনগণশূন্য হয়ে পড়ে। যারা শিক্ষিত, চিন্তাশীল, নীতিবান- তারা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়। ফলে নেতৃত্ব চলে যায় এমনদের হাতে, যারা হুমকি আর গালাগালকে ‘রাজনীতি’ মনে করে। এ চক্র যতদিন চলবে, ততদিন গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হতে থাকবে। রাজনীতির ভাষা হবে প্রগাঢ়, তীক্ষè।
এখন সময় এসেছে রাজনীতিতে নতুন এক সংস্কৃতি গড়ে তোলার- যেখানে শব্দ হবে শালীন, সমালোচনা হবে যুক্তিপূর্ণ, আর বক্তব্য হবে নীতিনিষ্ঠ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই নিজেদের বক্তাদের ভাষা নিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংসদ, টকশো, বা জনসভা- সব জায়গাতেই শালীনতার সীমা নির্ধারণ করতে হবে। ওসব হাদী মার্কা নেতা জনগণের আদর্শ হতে পারে না।
নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকেও এখানে দায়িত্ব নিতে হবে। নেতারা যখন কটু ভাষা ব্যবহার করেন, তখন সংবাদ শিরোনাম যেন সেটিকে ‘রসালো’ না বানায়, বরং তার অসংযম প্রকাশ করে। সামাজিক চাপ থাকলে রাজনৈতিক শালীনতা ফিরে আসতে বাধ্য। শুধু একে অপরের দোষ না ধরে, নিজে সংযত হতে হবে শব্দ প্রয়োগে। ভাষায়, চর্চায়, চিন্তায়।
সবিশেষ, বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক গভীর নৈতিক পরীক্ষার মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে হুমকি, গালাগাল ও বিভাজনের ভাষা, অন্যদিকে জনগণের আস্থা হারানো। কিন্তু এখনই যদি রাজনীতির ভাষা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া যায়- তাহলে রাজনীতি আবার তার সৌন্দর্য, মর্যাদা ও মানবিকতা ফিরে পেতে পারে। কারণ রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়। এটি মানবসভ্যতার উচ্চতম প্রকাশ। আর সেই সভ্যতার প্রথম শর্ত হলোÑ সংযমের ভাষা। যখন নেতারা বুঝবেন যে শব্দও এক ধরনের রাজনীতি, তখনই রাজনীতি আবার মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিক ও শ্রদ্ধার হবে। ততদিন পর্যন্ত আমাদের প্রশ্ন থেকে যাবে। রাজনীতির ভাষা কতটা অসংযত হতে পারে, আর আমরা কতদিন সেটি সহ্য করব?

