বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন, গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষকের জীবনমান ও উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে নেতৃত্বের দর্শন ও বাস্তব উন্নয়নকর্মের মাধ্যমে, তার যাত্রা শুরু হয়েছিল শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন যে অসংগঠিত কৃষক সমাজকে সংগঠিত করতে না পারলে কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদল মূলত জন্ম নিয়েছিল এই কৃষিনির্ভর দেশের কৃষক সমাজকে সংগঠিত করা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং কৃষিকে জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। আজ যখন কৃষক দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে, তখন ফিরে দেখা জরুরি, জিয়াউর রহমানের কৃষি বিপ্লব, বেগম খালেদা জিয়ার ধারাবাহিক কৃষিনীতি, এবং তারেক রহমানের আধুনিক কৃষি-দর্শন কীভাবে বাংলাদেশের কৃষিকে নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
শহিদ জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সৈনিক-রাষ্ট্রনায়কের চেয়েও বেশি, তিনি ছিলেন মাঠে নেমে কৃষকের পাশে থাকা একজন কর্মী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য উৎপাদন ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সেচ সমস্যা সমাধান না হলে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই তিনি হাতে কোদাল তুলে নিয়ে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি চালু করেন, যা ছিল শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, ছিল এক গণঅভ্যুত্থানমূলক অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি। ১৯৭৯-১৯৮১ সালের মধ্যে খনন করা হয় ২৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খাল। এসব খাল দেশের জলাধার পুনরুদ্ধার করে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের সুযোগ বাড়ায়, মাছ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং কৃষকদের জন্য স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করে। এতে শুধু ফসলের উৎপাদন বাড়েনি, গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছিল।
জিয়া কৃষি ক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক ও উদার অর্থনীতির দূরদর্শী সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন। কৃষি জমির আল তুলে দেওয়ার প্রস্তাব এরই অংশ ছিল, যা যৌথ খামার পদ্ধতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারত। তিনি কৃষি যন্ত্রপাতি ও সেচ উপকরণের বেসরকারিকরণের সুযোগ তৈরি করেন, ফলে গ্রামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে ওঠে, একজন সেচযন্ত্র মালিক পুরো এলাকার জমিতে পানি দেওয়ার কাজ করত। এর মাধ্যমে কৃষিতে এক ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হয়।
কৃষি আধুনিকায়নের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল বীজ সেক্টরের সংস্কার। ১৯৭৭ সালের বীজ অধ্যাদেশ দেশের কৃষি গবেষণা ও উন্নত জাতের বীজ উৎপাদনে নতুন যুগের সূচনা করে। পাশাপাশি সারের উৎপাদন, বিতরণ, সেচযন্ত্র, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, হার্ভেস্টারের বিস্তারসহ কৃষিতে প্রয়োজনীয় আধুনিক উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেন তিনি। খাদ্য নিরাপত্তায় জিয়াউর রহমান ছিলেন যুগান্তকারী ভূমিকার অধিকারী। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান-চাল ক্রয়, শস্যগুদাম ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ, খাদ্যের মজুত বৃদ্ধি, এসবের মাধ্যমে তিনি খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে উন্নীত করে তুলেছিলেন।
কৃষি গবেষণায়ও ছিল তার ঐতিহাসিক অবদান। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এবং দিনাজপুরের গম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি কৃষিপ্রযুক্তি, নতুন জাত উদ্ভাবন ও ফসল বৈচিত্র্যকরণে বিপ্লব ঘটান। ১৯৭৭ সালের বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচি ছিল ক্ষুদ্র কৃষকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রথম বড় উদ্যোগ। সেচ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠন করেন। কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ, সার, বীজ, সব খাতে তিনি যে সংস্কার ও আধুনিকায়নের সূচনা করেন, তা দুই বছরের মধ্যেই দেশের সবুজ বিপ্লবে পরিণত হয়।
জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেও কৃষি খাতে ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকে। তিনি নতুন নীতি গ্রহণের চেয়ে জিয়ার প্রতিষ্ঠিত নীতিকে সম্প্রসারণ, কাঠামোগত শক্তি বৃদ্ধি এবং কৃষকের সুবিধা নিশ্চিত করার দিকে নজর দেন। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণ মওকুফ, কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, এসব সিদ্ধান্ত সরাসরি কৃষকের অর্থনৈতিক স্বস্তি এনে দেয়। খাদ্য নিরাপত্তা, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, পল্লী বিদ্যুতায়ন, এসব কর্মসূচিতে তার সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয়, যা গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থায় গতির সঞ্চার করে। জিয়ার আমলে শুরু হওয়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ সম্প্রসারণ, উদার অর্থনীতিতে কৃষি বাণিজ্যের সুযোগ, এসব কৌশল খালেদা জিয়ার আমলে আরও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
১৯৮০ সালে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহ্বায়ক করে কৃষকদলের যাত্রা শুরু করেছিলেন এক ঝাঁক তারকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে নব্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ২০১৯ সালে কৃষকদলকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান। শুরু হয় নতুন পথচলা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনে কৃষকদল শুধু কৃষি অঙ্গনে নয়, আন্দোলনের মাঠেও স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে। চলমান আন্দোলনে কৃষকদল বিএনপির রাজনৈতিক অর্জনের এক বড় অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হয়। ফ্যাসিবাদ মুক্ত ২০২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে কৃষক দলের উদ্যোগে সারাদেশব্যাপী ৪৭৭৫টি ইউনিয়নে কৃষকদের সংগঠিত করতে তারেক রহমানের নির্দেশনায় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেসব সমাবেশে আগামী দিনে কৃষকদের জন্য করণীয় বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে জিয়াউর রহমানের কৃষি চিন্তাকে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কৃষিকে তিনি মনে করেন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ। তার ছয় দফা খাদ্য নিরাপত্তা অঙ্গীকারে কৃষিপ্রযুক্তি, পানি নিরাপত্তা, উৎপাদন দক্ষতা ও পুষ্টি নিশ্চয়তার বিষয়গুলো উঠে এসেছে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে। তারেক রহমান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেনÑ প্রথম ১৮ মাসে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন। এর বড় অংশই আসবে কৃষিভিত্তিক শিল্প থেকেÑ যেমন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ, খাদ্য বৈচিত্র্যকরণ শিল্প, রপ্তানিমুখী উৎপাদন। এজন্য তিনি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন।
তারেক রহমান কৃষকদের জন্য ‘কৃষক কার্ড’ চালুর ঘোষণা দিয়েছেন, যার মাধ্যমে কৃষক আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তি, ভর্তুকি ও সরকারি সেবা সহজে পাবে, মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমবে। তিনি নদী পুনরুদ্ধার ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান, যা সরাসরি জিয়ার খাল খনন কর্মসূচির আধুনিক রূপ। ধান উৎপাদনে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি অপচয় কমানোর পরিকল্পনা তাকে আধুনিক কৃষি জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব হিসেবে তুলে ধরে। সার্কুলার অর্থনীতি, বর্জ্য থেকে জ্বালানি, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন, কৃষিতে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এসব উদ্যোগ শুধু কৃষিকে শক্তিশালী করবে না, কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নকেও ত্বরান্বিত করবে।
তিনি বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা কৃষকের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। প্রান্তিক কৃষকের জন্য খাস জমিতে মাড়াইয়ের জায়গা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য কৃষি বিমা, এসব নীতি কৃষকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত করবে। কৃষিতে জিডিপির ৮% বরাদ্দের প্রস্তাব তার কৃষিমুখী মনোভাবকে আরও সুস্পষ্ট করে।
জিয়া শুরু করেছিলেন উৎপাদনের বিপ্লব, খালেদা জিয়া চালিয়েছেন ধারাবাহিক নীতির শক্তিশালী প্রয়োগ, আর তারেক রহমান কৃষিকে দিচ্ছেন আধুনিকতার নতুন রূপ, প্রযুক্তিনির্ভর, গবেষণাভিত্তিক, সুষম উন্নয়ন ও কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের ৪৫ বছরের যাত্রা তাই কেবল একটি সংগঠনের ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের কৃষক, জমি, উৎপাদন ও উন্নয়ন দর্শনের এক ধারাবাহিক রূপান্তরের কাহিনি। শহিদ জিয়ার সবুজ বিপ্লব, বেগম খালেদা জিয়ার কৃষিবান্ধব নীতি এবং তারেক রহমানের আধুনিক কৃষি স্বপ্ন, এসব মিলেই গড়ে উঠছে আগামী দিনের সম্ভাবনাময়, স্বয়ংসম্পূর্ণ, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ।
সামছুর রহমান শামস, লেখক : প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল

