ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশের অর্থনীতির অক্সিজেন রেমিট্যান্স

মির্জা হাসান মাহমুদ
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০১:৪০ এএম

বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ এক অনিবার্য শক্তি। বাংলাদেশে সেই প্রবাহের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। দেশের কোটি কোটি প্রবাসী তাদের ঘামঝরা শ্রমের অর্থ পাঠিয়ে নিজেদের পরিবারের জীবনযাত্রা যেমন পালটাচ্ছেন; তেমনি পুরো দেশের অর্থনীতিকেও তারা এগিয়ে নিচ্ছেন। তাদের পাঠানো অর্থ বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান এবং ব্যবসার প্রসারে আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বলা যায়, প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অদৃশ্য নায়ক।

রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড

বাংলাদেশের প্রবাসীরা যে হারে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে আশার আলো জ্বালাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে দেশে এসেছে ৩০.৩২ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৩২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্দিষ্ট অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের রেকর্ড। আগের অর্থবছর ২০২৩-২৪-এ রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬.৮০ শতাংশ। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে, সেবার প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২-এ আসে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, অবিরতভাবে প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া নতুন অর্থবছরের শুরুটাও হয়েছে আশাব্যঞ্জক। কেবল জুলাই মাসেই দেশে এসেছে ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স, যা আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। চলতি মাস আগস্টের প্রথম ১৭ দিনে এসেছে ১.৪২ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ কোটি ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছে। এর মধ্যে এক দিনেই (১৭ আগস্ট) দেশে এসেছে ১৬ কোটি ডলার, যা টাকার হিসাবে প্রায় ১ হাজার ৯৫২ কোটি।

এই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ দেশের মজুত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাবাজারেও স্বস্তি নিয়ে আসছে। ব্যাংক খাতের কর্মকর্তাদের মতে, প্রবাসী আয়ের এই প্রবৃদ্ধির ফলে ডলারের ওপর চাপ কমেছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রবাসীদের ভূমিকা

আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল প্রবাসীদের আস্থা বৃদ্ধি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সংঘাত, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে প্রবাসীরা একসময় রেমিট্যান্স শাটডাউনের হুমকি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থা রেখে তারা নতুন উদ্যমে বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেন। প্রবাসীদের এই প্রতিশ্রুতি শুধু অর্থনীতিতেই নয়, জাতীয় জীবনেও স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব

রেমিট্যান্স গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত করছে। অধিকাংশ প্রবাসী আয় সরাসরি গ্রামে পরিবারের কাছে পৌঁছায়। যার ফলে বাড়ছে ক্রয়ক্ষমতা, উন্নত হচ্ছে জীবনযাত্রার মান, গড়ে উঠছে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য। অনেক পরিবার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও গৃহনির্মাণে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক অর্থে বলা যায়, প্রবাসী আয়ের প্রতিটি ডলার গ্রামীণ উন্নয়নকে গতিশীল করছে।

সরকারের করণীয়:

এখন প্রশ্ন হলো- যারা দেশের অর্থনীতিকে প্রাণশক্তি দিয়ে সমর্থন করছে, সেই প্রবাসীরা কতটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন? সত্যি বলতে, সবসময় এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যায় না। প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠালে তারা প্রণোদনা পেলেও, বাস্তবে

ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা, অতিরিক্ত চার্জ এবং আমলাতান্ত্রিক হয়রানির মুখোমুখি হন। প্রবাসীদের কল্যাণে সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘমেয়াদে আরও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। যেমন-

রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করা :

বৈধ পথে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত, সুলভ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নির্ভর করতে হবে।

প্রণোদনার ধারাবাহিকতা :

বর্তমানে বিদ্যমান প্রণোদনা অব্যাহত রাখা ও প্রয়োজনে হার বাড়ানো দরকার।

কল্যাণ তহবিল শক্তিশালী করা :

প্রবাসীদের পরিবার যেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিমা সুবিধা পায়, সেই উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

হুন্ডি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ :

এ ক্ষেত্রে শুধু আইন প্রয়োগ করেই সমাধান করা সম্ভব নয়। শুধু সহজ বিকল্প তৈরি করেই অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বন্ধ করা সম্ভব।

বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি :

নতুন বাজার খুঁজে বের করে দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে রেমিট্যান্স আয় আরও বাড়বে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রবাসীরা শুধু রেমিট্যান্স প্রেরক নন; তারা দেশ উন্নয়নের অদম্য যোদ্ধা। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করছে, এমনকি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে। তাই সরকারের উচিত তাদের অবদানকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।