বিশ্ব যখন ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর ঘোষণার অপেক্ষায়, তখন আয়োজক দেশ নরওয়ে নিজেকে এক অস্বাভাবিক কূটনৈতিক উত্তেজনার সম্ভাব্য কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি এবার শান্তির এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার না পান, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকছে অসলো।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি জানিয়েছে যে তারা এরই মধ্যে এই বছরের শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নির্বাচন করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণার কয়েকদিন আগেই। ফলে গাজা যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ভূমিকা পুরস্কার বিবেচনায় আসেনি।
নরওয়ের সমাজতান্ত্রিক বামপন্থি দলের নেত্রী কির্স্টি বার্গস্টো বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে চরম দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, বাকস্বাধীনতার ওপর আক্রমণ করছেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আদালতের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছেন।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘নোবেল কমিটি একটি স্বাধীন সংস্থা, তবে আমি নিশ্চিত নই যে ট্রাম্প তা জানেন। আমাদের যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
নোবেল বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান PRIO-এর পরিচালক নিনা গ্রেগার বলেন, ‘যদিও গাজায় যুদ্ধ বন্ধে তার প্রচেষ্টার জন্য কিছুটা কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে, তবুও এটি একটি দেরিতে নেওয়া পদক্ষেপ। শান্তি প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রাম্পের পশ্চাদপসরণ, তার দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আঘাত এবং ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ—এসব কিছু আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছেন যে তাকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া উচিত। বিশেষ করে ২০০৯ সালে বারাক ওবামা যখন এই পুরস্কার পান, তখন থেকেই ট্রাম্পের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ কাজ করছে। তিনি মনে করেন, আব্রাহাম চুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূমিকা ও শান্তি প্রচেষ্টা ওবামার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি একাধিক মিথ্যা দাবি করে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি আটটি যুদ্ধ শেষ করেছেন। এর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান, ইসরায়েল-ইরান, মিশর-ইথিওপিয়ার মতো কিছু সংঘাতের কথা উল্লেখ করেন। অথচ এই দেশগুলোর মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ চলছিল না। ভাষ্যকার ও তথ্য-পরীক্ষকরা এসব দাবিকে ভিত্তিহীন বলেছেন। তবে এটাও স্বীকার করেন যে আন্তর্জাতিক বৈধতার প্রতীক হিসেবে ট্রাম্প নোবেল পুরস্কারটি পেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
নরওয়েজিয়ান সংবাদ বিশ্লেষক হ্যারাল্ড স্ট্যানঘেল বলেন, ‘ট্রাম্প যদি প্রতিক্রিয়া দেখান, তাহলে তা হতে পারে শুল্ক আরোপ, ন্যাটোতে অতিরিক্ত অবদান দাবি, এমনকি নরওয়েকে শত্রু ঘোষণা করার মতো চরম অবস্থান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের অনেক নেতার কাছেই বোঝানো কঠিন যে নোবেল কমিটি একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সংস্থা। ট্রাম্প এমন একজন, যিনি এই স্বাধীনতাকে সম্মান নাও করতে পারেন।’
ট্রাম্প একবার নরওয়ের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জেন্স স্টলটেনবার্গকে ফোন করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল শুল্ক নিয়ে আলোচনা, কিন্তু পরে তিনি নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গ তোলেন, যা নরওয়েজিয়ান কর্মকর্তাদের হতবাক করে দেয়। এতে বোঝা যায়, এই পুরস্কার নিয়ে ট্রাম্প কতটা আগ্রহী এবং ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে আছেন।
এদিকে, নোবেল পুরস্কারের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় উঠে এসেছে সুদানের জরুরি প্রতিক্রিয়া কক্ষ, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস এবং উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল লীগ ফর পিস অ্যান্ড ফ্রিডম-এর নাম।
নোবেল কমিটির পরিচালক ক্রিস্টিয়ান বার্গ হার্পভিকেন বলেন, ‘কমিটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে, যদিও সদস্যদের নিয়োগ হয় নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্টের মাধ্যমে। এই দ্বৈত বাস্তবতা মাঝে মাঝে জটিলতা তৈরি করে।’
এই মুহূর্তে অসলো এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। যেখানে সাধারণত নোবেল শান্তি পুরস্কার উদযাপনের প্রস্তুতি চলে, সেখানে এবার প্রস্তুতি চলছে সম্ভাব্য কূটনৈতিক ঝড় সামাল দেওয়ার। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও অপ্রত্যাশিত একজন নেতাকে পুরস্কার না দেওয়ার পর কী ঘটবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।