জনপ্রিয় অভিনেতা শাহেদ আলী। থিয়েটার, টেলিভিশন নাটক, সিনেমা এবং ওয়েব, সব মাধ্যমে অভিনয়ের বহুমাত্রিকতা দিয়ে দর্শকের মন জয় করেছেন তিনি। সম্প্রতি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে তার নতুন সিনেমা ‘ফেরেশতে’। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি গড়ে তুলেছেন অসংখ্য দর্শকপ্রিয় চরিত্র এবং আলোচিত কাজ। এই অভিনেতা দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন তার যাত্রাপথ, কাজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রকিবুল ইসলাম আফ্রিদি ব্যস্ততা।
নিয়মিত নাটক-বিজ্ঞাপনে কাজ করছি। সম্প্রতি ওটিটির কাজ করলাম। সামনে সিনেমার শুটিং আছে।
ফেরেশতে
সিনেমাটি ইরানি পরিচালকের। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ মানুষ ইরানি সিনেমা দেখে বড় হয়েছে। ইরানি গান-সিনেমার প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। এই প্রেক্ষিতে ইরানি কাজটিতে যুক্ত হওয়া। কাজটি করে চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সিনেমাটির পরিচালক বেশ সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী। কাজটা আমরা যেভাবে করেছি, সচরাচর এই ধাঁচে কাজ করি না বা করে অভ্যস্ত নই। কাজটি করতে গিয়ে একদমই নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
দর্শক কেন দেখবে?
আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশের কালচার, সমাজব্যবস্থা ও মানুষের জীবনের বিভিন্ন গল্পের সিনেমা দেখছি। কিন্তু ফেরেশতে সিনেমার মধ্যে একজন ইরানি চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশের জীবনকে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন। এই দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভিন্ন। তার গল্প বলার ধরন একেবারে আলাদা। বড় পর্দায় দেখলে অনেক পরিচিত বিষয় এই সময়ের দর্শকদের মনে হবে। এ ধরনের গল্প আমরা সচরাচর দেখি না। আমরা যে ধরনের সিনেমা দেখি তার থেকে এই সিনেমাটা একেবারেই ভিন্ন। দর্শকরা সিনেমাটি বড় পর্দায় দেখে আনন্দিত হবে।
মঞ্চ থেকে পর্দায় আসায় চ্যালেঞ্জ কি ছিল?
নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জটাই বড়। প্রত্যেক অভিনেতার নিজেকে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উপস্থাপনের আকাক্সক্ষা থাকে। নতুন ধরনের প্রস্তাব পেলে মনে হয়, এটা আমি না; আমার বাইরের কিছু। এটাকে নতুনভাবে উদ্ভাবনের এক ধরনের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। আগে যা কিছু চেষ্টা করেছি তার থেকে আরও ব্যতিক্রমী কিছু, অন্যভাবে একটি চরিত্রকে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা নিতে নিজেকে অতিক্রম করতে ভালো লাগে। থিয়েটার, নাটক, সিনেমা বা ওটিটি, সব কাজই ভিন্ন, একেকটা কাজ একেক রকম। প্রতিটিতে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের লড়াই আমাকে প্রতিনিয়ত করতে হয়, আর এই লড়াইটাই আমি উপভোগ করি।
গুরুত্ব
চরিত্র বাছাই করার সময় আগে দেখি গল্পে অবস্থান কি। চরিত্রটি গল্পের মধ্যে কি ভূমিকা রাখছে এবং কি অবস্থায় আছে। এই বিষয়টি সবার আগে দেখি। তারপর দেখি, পরিচালক গল্পে চরিত্রটিকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলছেন।
শিল্পীদের রাজনীতি
শিল্পীদের রাজনীতি সচেতন হতে হবে। রাজনীতি সচেতন হওয়া মানে রাজনীতি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া না। আমি মনে করি, শিল্পীদের সচেতনভাবে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত এবং কোনোরকম রাজনীতি দলের ট্যাগ, সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবি থেকে নিজেদের অনেক দূরে রাখা। কারণ, শিল্পী মূলত মানুষের কথা বলবে, মানুষ তো রাজনীতি প্রদান নিয়ে বাঁচে।
অভিজ্ঞতা
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিংবা নাটক-সিনেমায় কাজের অভিজ্ঞতা মিশ্র। ওটিটিতে সব কাজই দারুণ অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি করেছি। ওটিটিতে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে টেলিভিশনের কেউ যদি ওটিটিতে কাজ করতে আসে, তারা খুব একটা পার্থক্য করতে পারে না। তারা যে আলাদা একটি মিডিয়ার জন্য কাজ করছে, এ ধারণা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। আরও একটি মূল সমস্যা মনে হয়েছে প্রযোজনায়। টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রে প্রযোজক অনেক বড় বিষয় না, কিন্তু ওটিটির প্রযোজক অনেক বড় বিষয়। অনেক বড় একটা ভূমিকা প্রযোজকের আছে। সেই প্রযোজনা পর্যায়টি এখনো পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। যতদিন না গড়ে উঠবে, ততদিন পর্যন্ত ওটিটি নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাসিত হওয়ার অবকাশ নেই। ওটিটিকে একটি ভালো জায়গায় নিতে হলে সর্বক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব থাকতে হবে। পেশাদারিত্বের অর্থ- শুধু টাকার বিষয় নয়, পেশাদারিত্ব মানে হচ্ছে কাজটির প্রতি কমিটমেন্ট, মনোযোগ; ধ্যান, দক্ষতা দিয়ে করতে হয়। সেই প্রচেষ্টা নেওয়াটাকে আমার কাছে পেশাদারিত্ব মনে হয়। সেই জায়গাটির ঘাটতি এখনো আছে। ওটিটির ক্ষেত্রে আমরা এখনো পেশাদার হতে পারিনি।
রুচির পরিবর্তন
বড় পরিবর্তন প্রযুক্তিগত জায়গায়। দর্শক এখন যেভাবে বিশ্বের সমস্ত কিছু মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পারে। আজকে থেকে ৩০ বছর আগের দর্শক এত সহজে সবকিছু দেখতে পারত না। ৩০ বছর আগে একটা ভালো সিনেমা দেখতে হলে সিনেমা হল, বিভিন্ন জায়গা বা অনুষ্ঠানে এমনকি বিভিন্ন ফেস্টিভালে যেতে হতো। কিন্তু এখন দর্শক চাইলেই যেকোনো অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই বিশ্বের বিভিন্ন কাজ দেখতে পারে। এজন্যই দর্শকদের রুচি অনেক দ্রুত পরিবর্তন হবে। দর্শকদের রুচি কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল থাকছে না।
থিয়েটার, টিভি ও সিনেমা শিল্পে সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা কী?
আমার নিজের কাছে মনে হয়, থিয়েটারের নেতারা অনেক বড় বড় উদ্দেশ্য নিয়ে আছে। একেক জনের উদ্দেশ্য একেক রকমের। তাদের যদি থিয়েটার নিয়েই উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে থিয়েটারের ৫০ বছর পেরিয়ে দর্শক ও জনগণের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে দাঁড়াত। থিয়েটার তা কিন্তু হয়নি। ব্যক্তিগত স্বার্থে থিয়েটারের নেতারা বিভিন্ন কিছুর পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করেছে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও তাই। টেলিভিশনের নির্মাতা বা যারা আছে তাদের আসলে প্রত্যেকেরই নিজেদের নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছিল এতদিন পর্যন্ত। কারো হয়তো বা টাকা-পয়সা, খ্যাতি, কারো অধিপত্তি; কারো প্রশাসন বা ক্ষমতার নিকটবর্তী হওয়ার প্রচেষ্টা। এই ধরনের একেকজনের এক এক রকম এজেন্ডার কারণে এই জায়গাগুলোতে আসলে যেভাবে আসার কথা ছিল, যেভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল সেটা তো হয়নি। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ও লোভের জন্যই এই জায়গাগুলো সমৃদ্ধ করতে বাধাগ্রস্ত করেছে এসব নেতারা।
কখন উপলব্ধি করলেন অভিনয় পেশা হওয়ার উপযোগী?
ছোটবেলা থেকে অভিনয় অনেক ভালো লাগত। যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন শিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞাসা করে কে, কি হতে চাও। ক্লাস শিক্ষকের প্রিয় পাত্র ছিলাম আমি। যে কারণে আমাকে সবার শেষে জিজ্ঞাসা করেছিল। যখন পেশার কথা বলা হলো, তখন মনে হলো আমি আসলে অভিনেতাই হতে চাই। তখন উত্তরে শিক্ষককে বলি, আমি অভিনেতা হতে চাই। এই উত্তর শুনে স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এইটা কি খুব এলিজাবেল প্রফেশন?’ তখন আমি না বুঝেই এবং চিন্তাভাবনা না করে বলি, ‘স্যার আমি যখন করব তখন হবে’। ওই স্যারের ক্লাস রুমের মধ্যেই স্যারকে বলতে বলতে সিদ্ধান্ত নেই আমি এই পেশায় পেশাজীবী হব। তখনই জানতে পারি আমি অভিনেতা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন