- এই পদ্ধতিতে সরাসরি আমনের বীজ জমিতে রোপণ করা হচ্ছে
- কমে গেছে উৎপাদন খরচ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার
- পরিবেশবান্ধব হওয়ায় কমে গেল মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ
- বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে এই পদ্ধতি
- এই পদ্ধতিকে ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি বলা হচ্ছে
- খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে
- দিন দিন এ পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন কৃষক
উত্তরাঞ্চলে আবহাওয়ার চিত্র বদলে গেছে। বর্ষা মৌসুমেও হচ্ছে না কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত। ফলে বৃষ্টিনির্ভর আমন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক। ধান আবাদে জলবায়ু পরিবর্তনের এ অভিঘাত থেকে মুক্তি দিচ্ছে ডিএসআর বা সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতি। বীজতলা তৈরি, জমিতে ধানের চারা রোপণ, সেচের খরচ এড়িয়ে এ পদ্ধতিতে যন্ত্রের মাধ্যমে সরাসরি আমনের বীজ জমিতে রোপণ করা হচ্ছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমেছে।
সেই সঙ্গে ধান আবাদে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কম হচ্ছে। ফলন ভালো হওয়ায় রংপুর কৃষি অঞ্চলে দিন দিন এ পদ্ধতিতে আমন আবাদ বেড়েছে। পরিবেশবান্ধব ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান আবাদে শতকরা ২০ থেকে ৮০ শতাংশ মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কম হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিজ্ঞানীরা।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) রংপুর অফিস সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধান উৎপাদনে খরচ বাড়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে আমন উৎপাদনে সেচ বেশি প্রয়োজন হয়। ফলে রংপুর কৃষি অঞ্চলের অনেক এলাকায় আগাম আলু ও ভুট্টার পর জমির একটি বড় অংশ পতিত থাকে। তবে ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে ইরির সহযোগিতায় গত বছর নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৬০ বিঘা জমিতে প্রদর্শনী আকারে ডিএসআর পদ্ধতিতে ব্রি-৭৫ জাতের ধান আবাদ করা হয়। ওই বছর ভালো ফলনের পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এ পদ্ধতিতে ধান আবাদে ঝুঁকছেন কৃষক।
এ বছর কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৬০০ বিঘা জমিতে ডিএসআর পদ্ধতিতে আমন ধান আবাদ হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ধান আবাদ করায় কৃষকের বিঘাপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা সেচ ও শ্রমিক খরচ সাশ্রয় হয়েছে। এ ছাড়া ডিএসআর পদ্ধতিতে রোপিত আমনের জাত ব্রি-৭৫ ধান গাছের উচ্চতা কম, ঝড়ে হেলে পড়ার আশঙ্কা কম হওয়া এবং চাল চিকন হওয়ায় কৃষকরা এই ধান আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন। সেই সঙ্গে ব্রি-৭৫ জাতের ধান অন্য জাতের তুলনায় শতকরা ২০ শতাংশ পানি সাশ্রয়ে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ মেলাবাড়ি এলাকার কৃষক আব্দুল হাই বলেন, ‘গত বছর ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান আবাদ দেখে এ বছর চার বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছি। সরাসরি বীজ বপন করা যায় বলে আলাদা বীজতলা, সেচ দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হয় না। সেই সঙ্গে ধান রোপণের মৌসুমে শ্রমিক সংকট থাকে। যেহেতু পাওয়ার টিলার দিয়ে একেবারে জমি চাষ ও ধানের বীজ রোপণ হয়ে যায়, তাই সময় মতো ধান আবাদে শ্রমিক নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে না।’
ইরি বাংলাদেশের অ্যাগ্রি ফুড সিস্টেম স্পেশালিস্ট আবু আব্দুল্লাহ মিয়াজী বলেন, ‘ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান আবাদ হচ্ছে একটি ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি। অল্প চাষে, কম সেচে, শুকনা পদ্ধতিতে কৃষকরা ধান আবাদ করে লাভবান হচ্ছে। এক গবেষণা দেখা গেছে, প্রচলতি পদ্ধতিতে আমন আবাদের চেয়ে ডিএসআর পদ্ধতিতে ২০-৮০ শতাংশ মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কম হচ্ছে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় ডিএসআর পদ্ধতি ভূমিকা রাখছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় কৃষককে প্রশিক্ষণ, সহায়তা দিয়ে ডিএসআর পদ্ধতি সম্প্রসারণে কাজ করছি। এ পদ্ধতিতে সঠিক সময়ে জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করা গেলে ফলন অত্যন্ত ভালো হয়।’
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, ‘ডিএসআর পদ্ধতিতে ব্রি-৭৫ জাতের ধানটি ভালো হচ্ছে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এ জাতের ধানের আয়ুষ্কাল ১১৫ দিন। কিন্তু ডিএসআর পদ্ধতিতে ১০৭ দিনে কৃষক এ ধান কাটতে পারছেন। ফলন হচ্ছে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ টন। রংপুরের অনেক জেলায় আগাম আলুর পর ভুট্টা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ডিএসআর পদ্ধতিতে স্বল্পজীবনকালের এ ধান আবাদ কৃষকদের লাভবান করে তুলেছে। সেই সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নীলফামারীর উপ-পরিচালক ড. এসএম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকের খরচ কমিয়ে আনাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষির ওপর যে আঘাত আসছে, সেটি মোকাবিলায় ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমার জেলায় উঁচু ও মাঝারি জমিতে এ পদ্ধতিতে ধান আবাদ সম্প্রসারণ করার সুযোগ রয়েছে। আমরা ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান উৎপাদনের জন্য কৃষকদের রোপণ যন্ত্র দেব। এ ছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন করলে মিথেন গ্যাস অধিক পরিমাণ নিঃসরণ হয়; যা আমাদের জলবায়ুকে উত্তপ্ত করে তোলে। ডিএসআর পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমায়।’ ডিএসআর পদ্ধতি একদিকে যেমন খরচ কমাচ্ছে। উৎপাদন বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু সুরক্ষায় কাজ করছে।’