ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসাসেবা এখনো নাগালের বাইরে। সাত বছর আগে শুরু হওয়া নয়তলা ভবনের নির্মাণকাজ এখনো অসম্পূর্ণ। লিফট, বিদ্যুৎ ও যন্ত্রপাতি না থাকায় ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু তড়িঘড়ি করে হাসপাতালটির উদ্বোধন করলেও দুই বছর পার হলেও কার্যক্রম চালু হয়নি। চিকিৎসক সংকটে সামান্য জটিলতায়ও রোগীদের বরিশালে পাঠানো হচ্ছে।
জানা যায়, গত ২০১১ সালে একনেক সভায় ঝালকাঠির জন্য একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, তৎকালীন সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমুর ব্যর্থতা ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে প্রকল্পটি আটকে যায় এবং পরবর্তীতে ২০২১ সালে পিরোজপুরে সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে ঝালকাঠিবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ভেঙে যায়। স্বাস্থ্যসেবা আরও ভেঙে পড়ে। ঝালকাঠি নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর আহম্মেদ বলেন, ‘লিফট ও অন্যান্য কাজে কমিশন জটিলতার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবেই মেডিকেল কলেজ ঝালকাঠি থেকে পিরোজপুরে সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে ঝালকাঠির স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে।’
জানা যায়, ১৯৮৪ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করা সদর হাসপাতাল ২০০৩ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এদিকে, ২০২৩ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সার্ভিস ভবনের কাজ শুরু হলেও লিফট, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ না থাকায় সেটিও চালু হয়নি। একইভাবে অক্সিজেন জেনারেটর প্লান্টও অসমাপ্ত পড়ে আছে।
এদিকে, হাসপাতালে জন্য লিফট ক্রয় করার জন্য গণপূর্ত বিভাগ চার কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেনি, ফলে তা বাতিল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্তকে জানায়, এই বরাদ্দে ২৫০ শয্যা হাসপাতালের জন্য যে লিফট দরকার এই দরে তা আন্তর্জাতিক বাজারে নেই।
২৫৯ শয্যা হাসপাতালের জন্য ১৬ জন মেডিকেল কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছেন মাত্র ৪ জন। দুপুর ২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগ চালাতে হচ্ছে একজন জেনারেল ডাক্তার ও একজন ইমার্জেন্সি মেডিকেল কর্মকর্তাকে নিয়ে।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার তারুলী গ্রামের মিনারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে চিকিৎসা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। সামান্য কিছু হলেই বরিশালে পাঠিয়ে দেয়। ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে ঠিকমতো কথাই বলেন না, প্রেসক্রিপসনের বেশির ভাগ ওষুধই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। বাইরের দোকান থেকে অনেক দামে ওষুধ কিনতে হয়।
রাজাপুর থেকে আসা হরমুজ মৃধা আরেকজন রোগী অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, ডাক্তারও কম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বললেই দালালরা ঘুরে আসে, তারপর বাইরে ক্লিনিকে পরীক্ষা করাতে যেতে বাধ্য হই। আর হাসপাতাল শুনছি বড় হবে, সামনে বড় বিল্ডিং পড়ে আছে কিন্তু কোনো কার্যক্রম দেখছি না।
টিআইবি কর্তৃক পরিচালিত ঝালকাঠি সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি সত্যবান সেনগুপ্ত বলেন, মেডিকেল কলেজ হাতছাড়া, ২৫০ শয্যার হাসপাতাল অচল থাকা, ডাক্তার ও যন্ত্রপাতির সংকট- সব মিলিয়ে ঝালকাঠিবাসীর স্বাস্থ্যসেবা চরম দুরবস্থায় পড়েছে। প্রতিদিন শত শত রোগী ন্যূনতম চিকিৎসার জন্য বরিশাল যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, অবিলম্বে লিফট স্থাপন, চিকিৎসক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণ না হলে জেলার স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।
ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের সদর হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও মূলত লিফট সংকটের কারণে ভবনের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। বরাদ্দ কম থাকার কারনে লিফট স্থাপন সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি বিশেষায়িত ডাক্তার না থাকায় রোগীদের রেফার করতে হচ্ছে। তবে যতটা সম্ভব আমরা এখানেই চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি।