পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্রকৃতির অন্যতম লীলাভূমি। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে চা-বাগান। একদিকে ঝরনা অন্যদিকে বিস্তীর্ণ হাওর। আছে এশিয়ার অন্যতম রেইনফরেস্ট কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বিপুল সম্ভাবনা থাকা মৌলভীবাজারকে সরকার পর্যটন জেলা ঘোষণা করে ২০০৮ সালে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে কাজ না করায় এরপর এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও হয়নি ‘চায়ের দেশ’ ও ‘জলকন্যা’ মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্পের বিকাশ। পর্যটকরা দুর্ভোগ মেনে নিয়েও মৌলভীবাজারে বিশেষ করে কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গর উপজেলার পর্যটনকেন্দ্রে এলেও সরকারি উদ্যোগে পর্যটনের তেমন উন্নয়ন হয়নি।
পর্যটনসংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটক আকৃষ্ট করতে জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলো নতুন করে সাজানো, সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, অবকাঠামোর আধুনিকায়ন, বিমানে যাতায়াতের ব্যবস্থা, পর্যটকদের সুরক্ষা, উন্নত সেবা নিশ্চিত এবং বাড়তি খরচ কমিয়ে কম খরচে সবার যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে এখানের দর্শনীয় স্থান নিয়ে বৈচিত্র্যময় শিল্পের প্রচারণা চালাতে হবে। তবেই পর্যটকশিল্প বিকশিত হবে। এর মধ্য দিয়ে চাকরি ও কর্মসংস্থান বাড়বে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি চাঙা হবে।
পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ চা-বাগান, হাওর, নদী, পাহাড় ও সমতলের বৈচিত্র্যপূর্ণ জনপদ মৌলভীবাজারকে ঘিরে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুদূরপ্রসারী কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতা, অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব আরও বিনোদনকেন্দ্রে যাতায়াত ও উন্নত মানের গাইডের অভাবে মৌলভীবাজারের পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এখানে সব মৌসুমে দেশ-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। তবে যে পরিমাণ পর্যটক আসার কথা কিংবা পর্যটকদের কেন্দ্র করে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না। অথচ জেলায় দুই শতাধিক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে।
হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটন জেলা ঘোষণার এত দিন পরও মৌলভীবাজারকে সেভাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পর্যটক আকর্ষণ, তাদের নির্দেশনা, নিরাপত্তা, আবাসন ও বিনোদনের পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বড়লেখার মাধবকু- জলপ্রপাত, কমলগঞ্জের হামহাম ছড়া জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল, জুড়ি-বড়লেখার হাকালুকি হাওর, মাধবপুর লেক ও ইকোপার্ক, ওয়াটার ট্যুরিজমের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এ জেলায়। তবে নান্দনিকতার অভাবে পর্যটনের বিকাশ আটকে আছে।
শ্রীমঙ্গল চামুং রেস্তোরাঁ এবং ইকো ক্যাফে স্বত্বাধিকারী তাপস দাস বলেন, ‘সরকারি সহায়তার অভাবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব রয়েছে, বিনোদনের নেই কোনো ব্যবস্থা, পর্যটন স্পটে সহজ যাতায়াত ও উন্নত মানের ভ্রমণ গাইডের অভাবে জেলার পর্যটনশিল্প বিকশিত হচ্ছে না। নান্দনিকতা ও বিনোদনের অভাবে পর্যটকরা এ জেলা থেকে মুখ ফিরে নিতে যাচ্ছে।’
কমলগঞ্জ উপজেলার অরন্য নিবাস ইকো রিসোর্টের পরিচালনা কমিটির সদস্য এহসান কবির সবুজ বলেন, ‘পর্যটকদের যাতায়াতের সমস্যা। ঢাকা বা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা আমাদের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন রিসোর্টে আসেন। কিন্তু আসা এবং যাওয়ার পথে তাদের প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় সড়কপথে যাতায়াত ও ট্রেনের টিকেট সমস্যা। এ জেলায় আসার যাওয়ার কোনো ভালো গাড়ি নেই। যদি সিলেট রেলপথে পর্যটনবাহী ২টা ট্রেন দেওয়া হয় তাহলে পর্যটকে ভরপুর থাকবে এ জেলা। আবার শমশেরনগর বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ বিমান সাভির্স চালু হলেও পর্যটকদের বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের আগমন অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, ঈদ, পূজায় স্কুল বন্ধ থাকলে হাজারো পর্যটকের সমাহার থাকে। আমাদের ও অন্যদের রিসোর্ট ফিলাপ থাকে। যদি তাদের পরিপূর্ণ সার্ভিস দিতে হয়, তাহলে দ্রুত ভালো যানবাহানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য তিনি সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
পর্যটনসেবা সংস্থার সদস্য ও পরিবেশবাদী এসকে দাশ সুমন বলেন, ‘একই স্পট বারবার দেখতে পর্যটকেরা পছন্দ করেন না। তারা নতুনত্ব চান। মৌলভীবাজারে পর্যটকদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটছে না। বিনোদনকেন্দ্রিক আরও নতুন কিছু গড়ে ওঠা দরকার। একাধিকবার বিভিন্ন দপ্তরের এসব বিষয়ে আলোচনা হলেও লাভ হয়নি। সরকার ভালো উদ্যোগ নিলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারত।’
মৌলভীবাজার পর্যটনসেবা সংস্থার সদস্য সচিব শামছুল হক বলেন, ‘জেলায় বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। এ জেলায় দেশের শীর্ষভাগ চা-বাগান। রয়েছে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। পর্যটনকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থা ও উন্নত মানের অবকাঠামো না থাকলেও অভ্যন্তরীণ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, অবকাঠামোগত সুবিধা ও প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য রয়েছে। পাহাড়, টিলা, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, হাওর-বাঁওড় বিল, ঝরনা, নদ-নদী পরিবেষ্টিত ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ জেলা ইকো-ট্যুরিজমের জন্য খুবই উপযোগী। এ কারণে প্রতিবছর বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক এ জেলায় ভ্রমণে আসেন।’
গতকাল বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে কমলগঞ্জে আয়োজিত আলোচনা সভায় কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাখন চন্দ্র সুত্রধর বলেন, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম আছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে, পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় সহজে যাতায়াতে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ প্রস্তাবনা সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ইসরাইল হোসেন বলেন, মৌলভীবাজারে পর্যটকদের আকৃষ্টে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন