পুলিশকে সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব ও মানবিক পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংস্কারের বিকল্প নেই। কোনো সরকারই স্বাধীন পুলিশ কমিশন করতে চাইবে না। এ জন্য পুলিশের পদোন্নতি ও বদলির আলাদা আইন করা প্রয়োজন। সর্বোপরি পুলিশকে সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মত দিয়েছেন বক্তারা।
গতকাল শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি। এতে বিচারপতি, সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুধীজনেরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কল্যাণ সমিতির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি ড. এম. আকবর আলী। সমিতির সহসভাপতি আব্দুর রহমান খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা। অনুষ্ঠানে সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, ২৫-৩০ বছর আগে যে পুলিশ ইউরোপ-আমেরিকায় দেখেছি, তার ধারেকাছেও আমরা যেতে পারিনি। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। পুলিশ সংস্কার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেছে। পুলিশ সংস্কার নিয়ে সবার মধ্যে আকাক্সক্ষা ছিল। নতুন বাংলাদেশে সৃষ্টির জন্য পুলিশকে পূর্ববর্তী অন্ধকার যুগের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং দেখিয়ে দিতে হবে পুলিশ খারাপ না, কিছু খারাপ সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলÑ প্রধান উপদেষ্টার এ কথা আজকে সবার মনের কথা। মুখ্য আলোচক হিসেবে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, পুলিশ সংস্কার করতে হলে প্রথমেই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, বেঁচে থাকার মতো সুযোগ-সুবিধা, দুর্নীতিমুক্ত, প্রশিক্ষণ আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। এ ছাড়া পুলিশের বিশেষ শাখা র্যাব থেকে সামরিক কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় তিনি পুলিশের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশের অধপতন হয়েছে। শেখ হাসিনার সময় পুলিশে ‘চেইন অব কমান্ড’ ছিল না। জুলাই বিপ্লবের পূর্বে পুলিশ ছিল দানবীয়। আজ পুলিশ মনোবলহীন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
নিজের রিমান্ডকালীন অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, তখন যারা ডিবিতে ছিলেন, তারা হয়তো ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অথবা অন্যান্য পর্যায়ের নেতা। জুলাই বিপ্লব এ জন্য অনিবার্য ছিল। এখন আমাদের টার্গেট হলো আরেকটা ফ্যাসিবাদ যেন ফিরে না আসে সেই ব্যবস্থা করা। গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধে সাবেক ডিআইজি ড. মতিয়ার রহমান বলেন, পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ঔপনিবেশিক আইন ও কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব এবং কর্মচাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক ও গণমুখী আইন প্রণয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও মনোভাব পরিবর্তন, পুলিশকে অযাচিত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা।
তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর কাজের ওপর নিরপেক্ষভাবে নজরদারি নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। এই কমিশনে সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও নারীসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি থাকবেন। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানবাধিকারসম্মত এবং জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. বোরহান উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশে যে আইন আছে, সেটা প্রয়োগ হয় না। ওটা প্রয়োগ করার পর আপডেট করতে হবে। পুলিশের আইন পিআরবিতে বেঙ্গল রাখা হয়েছে, এটার পরিবর্তন দরকার। এ ছাড়া এত বড় আইনের বই রাখা যাবে না। এর পাশাপাশি পুলিশের জন্য একটি পৃথক আইন দরকার। এতে তাদের পদোন্নতি, বদলি, ছুটি ও ডিউটির কথা উল্লেখ থাকতে হবে। বাংলাদেশে যেই সরকার হবে, কেউ স্বাধীন কমিশন করবে না। তবে করাটা খুব কঠিন কাজ। তিনি বলেন, পুলিশকে সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে বিশেষ কিছু স্থানে আবার লাগবে। সেটা আগেই চিহ্নিত করতে হবে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। খেলাফতে মজলিস বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ড. আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, পুলিশকে কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য পুলিশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য জারিফ রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে পুলিশ সংস্কারকে বাদ দেওয়া জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে একধরনের বেইমানি।
আপনার মতামত লিখুন :