বাংলাদেশের একেবারে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। দেশের শুরুও বলা যায় এখানে। এখান থেকেই দেখা মেলে হিমালয়ের পর্বতমালা কাঞ্চনজঙ্ঘা; শীতকালে পাহাড়ের চূড়ায় যখন বরফজমে যায় দূর থেকে দেখার জন্য ভিড় করে পর্যটকরা। এই পর্বতমালার কারনের বাংলাদেশে শীতের তীব্রতাও অনেক বেশি। বলা বাংলাদেশে শীত দেখতে চলে যাও উত্তরে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই শীতে উত্তরের সব জেলা নতুন রূপে রাঙিয়ে ওঠে। কুয়াশামাখা সকালে পাখির গুঞ্জন, সকালে খেতের মধ্যে ফসল তোলা, বাড়ি বাড়ি পিঠা বানানো, শীতের মধ্যে হাত পা কাপা কাপা অবস্থায় পুকুরে জাল ফেলা পঞ্চগড় তথা উত্তরবঙ্গের একটা ঐতিহ্য এখনো বিরাজমান। এই শীত দেখতে অনেকে ট্যুর দিয়ে থাকেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্নপ্রান্তে তেমনি এক জায়গা পঞ্চগড়, এখানে দেখা মিলে ঐতিহ্যবাহী দালানকোঠা, ভিতরগড় দুর্গ, মহারাজার দীঘি, কাজল দীঘি, বরদেশ্বরী মন্দির, চা বাগান, রকস্ মিউজিয়াম, মির্জাপুর শাহী মসজিদসহ আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই শীতে কেউ যদি পঞ্চগড় দেখতে যায় তবে সে কাঞ্চঙ্ঘা, হিমালয়, পাহাড়, ইতিহাস গ্রামের পরিবেশ সব একসঙ্গে পাবে এক জায়াগায়।
পাহাড় দেখা
পঞ্চগড় ভ্রমণের মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে তেঁতুলিয়া। শীতকালে তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা মনে ধরে থাকবে। খুব ভোরে উঠে যদি যেতে পারেন বিশেষ করে শীতে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে আপনার চোখে ধরা দেবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাহাড়ে সূর্যের প্রথম আলো পড়তেই বরফঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা লালচে-সোনালি রং ধারণ করে; এই দৃশ্য চোখে পরতেই মনে হবে যেন এতক্ষণের ভ্রমণ সার্থক। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে মনে হবে যেন হিমালয় যেন বাংলার মাটিতেই আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর (বর্তমানে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো), বাংলাবান্ধা পিকনিক কর্নার, এবং মহারাজার দীঘির আশপাশ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান।
শীতের রহস্যময়রূপ
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে তেঁতুলিয়ার তাপমাত্রা মাঝে মাঝে ৫-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে সচরাচর দেখা যায় না। ভোরবেলা ঘন কুয়াশা আর কনকনে বাতাস এ অঞ্চলকে এক রহস্যময় রূপ দেয়।
সবুজের গালিচা
পঞ্চগড়কে এখন বাংলাদেশের চায়ের দ্বিতীয় রাজধানী। দিগন্তজোড়া সমতল ভূমির চা-বাগানগুলো ভ্রমণকে সহজ ও আরামদায়ক করে তোলে। শীতের সকালবেলা এখানাকার চা বাগানে হেঁটে বেড়ানো এক স্বর্গীয় অনুভূতি দেবে; মনে হবে যেন আপনে কোনো সবুজের গালিচা ঘুরে বেরাচ্ছেন। চাপাতার ডগায় জমে থাকা শিশির, কুয়াশার স্তর আপনাকে ক্যামেরা বন্দি করতে মনে চাইবে আপনার হাতে যদি ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন থাকে আপনে তুলে ফেলতে পারেন শীতের অপরূপ বাংলা। এ ছবি আপনাকে সারা বছর তারা দেবে। আপনি চাইলে অনুমতি সাপেক্ষে চায়ের কারখানা বা প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখতে পারেন, যা চা-প্রেমীদের জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
ইতিহাসের পাতায় পঞ্চগড়
পঞ্চগড় কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, এর রয়েছে অনেক প্রাচীন ইতিহাস এখানে রয়েছে অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন যার মধ্যে আছে ভেতরগড় দুর্গনগরী; পঞ্চগড়ের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন, যা মূলত একটি প্রাচীন দুর্গনগরী। এটি মধ্যযুগের অন্যতম এক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। রকস মিউজিয়াম; পঞ্চগড় শহরের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর। মহারাজার দীঘি; সুবিশাল আয়তনের এই দীঘিটি জনশ্রুতি এবং ইতিহাসে মোড়া। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট; বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের স্থলবন্দর। তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো; মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা।
পিঠা আর চায়ের গল্প
পঞ্চগড়ের শীত কেবল প্রকৃতির ঠান্ডা নয়Ñ এটি এখানকার মানুষের জীবনযাত্রারও অংশ। সকালের বাজারে চুল্লির ধোঁয়া, খেজুর গুড়ের মিষ্টি গন্ধ আর পিঠা বানানোর ব্যস্ততা এখানকার দৈনন্দিন জীবনের ছবি। স্থানীয় চায়ের দোকানে মিঠাই চা বা কালো চায়ের কাপ হাতে বসে স্থানীয়দের সহজ-সরল জীবনের গল্প শোনা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এখানকার বিখ্যাত চা, দেশীয় ভুট্টা, এবং শীতের মৌসুমে তৈরি নানান ধরনের পিঠা ও অরিজিনাল দই অবশ্যই চেখে দেখুন।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় ভ্রমণের জন্য ট্রেন বা বাস দুটোই জনপ্রিয়। ট্রেন; পঞ্চগড় এক্সপ্রেস পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় (ঢাকা থেকে রাত ১১:৩০ মিনিটে ছেড়ে যায়)। এ ছাড়াও একতা এবং দ্রুতযান এক্সপ্রেস নিয়মিত চলাচল করে। বাস; নাবিল, হানিফ, গ্রীন লাইন, শ্যামলীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এসি ও নন-এসি বাস সার্ভিস রয়েছে।
শীতকালে পঞ্চগড় ভ্রমণ আপনার জন্য একটি শুধু ভ্রমণই নয় এটি আপনাকে নিয়ে যাবে শান্ত মন, ইতিহাস ও প্রকৃতির মাঝে । শুধু তাই নয় সঙ্গে বোনাস হিসেবে দেখা যাবে পাহাড়ে চড়া, হিমালয় দেখা চায়ের চুমুক।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন