পবিত্র হজ মৌসুমের প্রস্তুতির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মক্কায় শিলাবৃষ্টি ও ধূলিঝড় জনমনে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ‘খামসিন’ নামক মৌসুমি নিম্নচাপের কারণে বুধবার ভয়াবহ ধুলিঝড় আঘাত হেনেছে মধ্যপ্রাচ্যের ৯টি আরব দেশে।
আরব দেশজুড়ে এই ধূলিঝড় তাণ্ডব চালিয়েছে এবং এর প্রভাব সরাসরি মক্কা, জেদ্দা, তাইফ ও মিনার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পড়ছে।
সৌদি আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মক্কা অঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিমি বেগে ধূলিঝড় বয়ে গেছে এবং এর সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টিও হয়েছে।
এতে অনেক সড়কে পানি জমে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, এই পরিস্থিতি শুধু পরিবহণ নয় বরং হজ সম্পর্কিত অবকাঠামোগত প্রস্তুতিকেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিশেষ করে মিনার খোলা মাঠ, আরাফাহ উপত্যকা এবং মুজদালিফার মতো এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন এবং বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার প্রস্তুতিতে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, ধূলিঝড় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগা হাজীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ধূলিঝড় ও শিলাবৃষ্টির পটভূমি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
‘খামসিন’ মৌসুমি নিম্নচাপ মূলত এপ্রিল-মে মাসে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মরু অঞ্চলে ধুলো ও বালুর প্রবাহকে তীব্রতর করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব দুর্যোগের ঘনত্ব এবং তীব্রতা দিনদিন বাড়ছে। ফলে সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে জনস্বাস্থ্যের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মক্কার স্বাস্থ্য বিভাগ জরুরি ভিত্তিতে ‘রেসপাইরেটরি ক্লিনিক’ চালু করেছে এবং হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত মেডিকেল স্টাফ ও অক্সিজেন সাপ্লাই বাড়িয়েছে। শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং জনসাধারণকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
এছাড়া, মিনার নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যা ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই অবস্থায় হজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং রিয়েল-টাইম আবহাওয়ার আপডেট হাজীদের কাছে পৌঁছে দিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মক্কায় শিলাবৃষ্টি ও ধূলিঝড়
সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, আবহাওয়ার যেকোনো বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। মসজিদুল হারামে ছাদের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং উন্নত নিকাশী ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখা হয়েছে। মিনায় ক্যাম্প স্থাপন ও বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর দূরবর্তী বিষয় নয়। মক্কার মতো মরু অঞ্চলও এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিণতির শিকার। ফলে ভবিষ্যতের হজ ব্যবস্থাপনায় আরও টেকসই ও পরিবেশ-বান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
মরু অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধূলিঝড় ও শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। NOAA–র মতে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে আঞ্চলিক জলবায়ুর স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে হঠাৎ করে ঝড়, বৃষ্টি এমনকি বন্যাও তৈরি হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, হজের মতো বড় আকারের আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।
হাজীদের করণীয় ও সরকারের দিকনির্দেশনা
হজে আগত মুসল্লিদের প্রতি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, আবহাওয়ার অবনতি হলে তারা যেন খোলা স্থানে না বের হন এবং নিয়মিতভাবে সরকার কর্তৃক প্রেরিত আবহাওয়ার আপডেট অনুসরণ করেন।
তাদের জন্য বিতরণ করা হচ্ছে ফেস মাস্ক, চোখ রক্ষাকারী গগলস এবং জরুরি ঔষধপত্র। এছাড়া, আগত মুসল্লিদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে আবহাওয়াবান্ধব তাবু এবং নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র।
ভবিষ্যতের হজ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ভূমিকা
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং, স্মার্ট নোটিফিকেশন এবং ডিজিটাল ম্যাপিং চালু করা হয়েছে। এতে করে দুর্যোগকালীন সময়েও হাজীরা নিজেদের অবস্থান ও নিরাপদ রুট সম্পর্কে জানতে পারছেন।
এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে আবহাওয়া পূর্বাভাস উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দুর্যোগ মোকাবিলা অনেক সহজতর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে মক্কায় শিলাবৃষ্টি ও ধূলিঝড় হাজীদের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ, তেমনি এটি হজ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। প্রশাসন যতই প্রস্তুতি গ্রহণ করুক না কেন, প্রকৃতির এই অপ্রত্যাশিত আচরণ মোকাবিলায় সচেতনতা এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই একমাত্র উপায়।
হজ মৌসুমে মক্কায় ধূলিঝড় কতটা সাধারণ?
মৌসুমি পরিবর্তনের কারণে এপ্রিল-মে মাসে ধূলিঝড় দেখা দিলেও এতোটা তীব্রতা অস্বাভাবিক। ২০২৫ সালে তা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।
ধূলিঝড় ও শিলাবৃষ্টির সময় হাজীদের করণীয় কী?
আবহাওয়ার আপডেট শুনে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করা উচিত। ফেস মাস্ক ও চোখের সুরক্ষার সরঞ্জাম ব্যবহার জরুরি।
এই ধরণের দুর্যোগ হজ ব্যবস্থাপনায় কী প্রভাব ফেলে?
অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনা, চিকিৎসা সরঞ্জাম বিতরণ এবং পরিবহণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, ফলে হজ ব্যবস্থাপনার গতি কমে যায়।
সৌদি সরকার এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
মেডিকেল টিম মোতায়েন, স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুতি এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম আপডেট দেওয়া হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মক্কায় দুর্যোগ বাড়ছে কি?
হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা বলছেন মরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধূলিঝড় ও বৃষ্টিপাতের হার বাড়ছে, যা হজ মৌসুমে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে হাজীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে?
স্মার্ট নোটিফিকেশন, ডিজিটাল ম্যাপিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে হাজীদের অবস্থান ও নিরাপদ রুট সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :