রাজপথে রক্তমাখা গলা, ছেঁড়া জামা, মুখে আর্তনাদ: ‘ও মা গো! এমন দৃশ্যের নায়ক তিনি! কিন্তু এই সিদ্দিক তো সেই অভিনেতা সিদ্দিক না, যিনি একসময় অভিনয়ে প্রাণ দিতেন, হাজারো দর্শকের মুখে হাসি ফুটাতেন।
নির্মাতা শরাফ আহমেদ জীবনের বেদনার স্ট্যাটাসে যেন সেই বিভ্রম ভেঙে পড়ে,‘এই সিদ্দিক কোন সিদ্দিক!!!’
ঘটনা গত ২৯ এপ্রিল, কাকরাইলে বিকেল চারটার দিকে। পথচলতি মানুষ চিনে ফেলল অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমানকে। কেউ কেউ অভিযোগ তুলল, ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ তিনি।
মুহূর্তেই উত্তপ্ত জনতা ঘিরে ধরে, কেউ স্লোগান তোলে আর কেউবা হাত। ভিড়ের মাঝে পড়ে যান এককালের জনপ্রিয় কমেডি অভিনেতা। এক সময়ের হাসির ফেরিওয়ালাকে এবার কাঁদতে শোনা যায়,‘ও মা গো!’
এই ঘটনার পরদিনই ফেসবুকে নির্মাতা শরাফ আহমেদ জীবনের স্ট্যাটাস যেন এক করুণ আত্মজিজ্ঞাসা। তিনি লেখেন,‘সব পরিবর্তন ভালো না! কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।’
তারপর স্মরণ করান নিজের কাজ ‘চৌধুরী সাহেবের ফ্রি অফার’-এর কথা, যেটাতে সিদ্দিক ছিলেন মুখ্য চরিত্রে। এক সময় ‘কমেডি আর ভাড়ামির’ মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই মানুষটা পরে হয়ে ওঠেন অর্থ আর ক্ষমতালোভী,এমনটাই অভিযোগ জীবনের।
তার ভাষায়,‘সিদ্দিক আরও লোভী হয়ে উঠল। তার অনেক টাকা, পাওয়ার লাগবে। সে রাজনীতির মতো সহজ পেশায় নিজেকে নিয়োগ করল।’
সিদ্দিকের ছেলের প্রসঙ্গ তুলে জীবনের প্রশ্ন, ‘আমার ছেলে ঋদ্ধের বয়সি। ও কি বাবার এই মার খাওয়ার দৃশ্য দেখেছে!? যদি দেখে থাকে তাহলে কেমন লাগছে!!!’
অবশেষে জীবন এই লেখার মাধ্যমে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করান আমাদের,‘এই সিদ্দিক তো আমার চেনা সিদ্দিক না! এই সিদ্দিক তো অভিনেতা সিদ্দিক না!’
শিল্পী হিসেবে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেও জীবন জানান,‘শিল্পীদের রাজনৈতিক ফিলসোফি থাকা দরকার আছে। তবে এই রকম ফিলসোফি না। শিল্পীদের জন্য তো আরও না!!!’
এই স্ট্যাটাস থেকে স্পষ্টভাবে যে বার্তাটি উঠে আসে তা হলো,সব পরিবর্তন কল্যাণ বয়ে আনে না, কিছু পরিবর্তন মানুষের সত্তা ও অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেয়।
অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমানের জীবনের গতিপথ এক সময় ছিল প্রশংসনীয়; ছোটপর্দার একজন জনপ্রিয় মুখ থেকে রাজনীতির মঞ্চে ওঠার স্বপ্ন দেখা এক শিল্পীর গল্প। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতার মোহ তাকে এমন এক পথে ঠেলে দেয়, যেখানে শেষটা হয় অপমানজনক, করুণ ও বিতর্কিত।
শরাফ আহমেদ জীবনের মতো একজন অভিজ্ঞ নির্মাতা যিনি সিদ্দিককে খুব কাছ থেকে চেনেন, তার এই আবেগী প্রতিক্রিয়ায় ফুটে উঠেছে এক নির্মাতা ও সহশিল্পীর ভেতরের ক্ষোভ, হতাশা ও যন্ত্রণা।
তিনি যেভাবে স্মরণ করেন ‘চৌধুরী সাহেবের ফ্রি অফার’এর মত কাজগুলো, সেগুলো আসলে সিদ্দিকের সৃষ্টিশীলতার এক সময়ের গৌরবময় উদাহরণ। কিন্তু সেই গৌরব ধীরে ধীরে ঢেকে যায় ক্ষমতা, লোভ ও আত্মবিস্মৃতির অন্ধকারে।
জীবনের প্রশ্ন,‘এই সিদ্দিক কোন সিদ্দিক?’,আসলে শুধু সিদ্দিককে নয়, অনেক শিল্পী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের জন্যই এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা।
একজন শিল্পীর রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে, কিন্তু সেটি যদি আত্মমর্যাদা ও পেশাদারিত্ব বিসর্জন দিয়ে হয়, তাহলে সেটি শিল্পের চেতনাবিরুদ্ধ।
সিদ্দিকের ছেলের প্রসঙ্গটি স্ট্যাটাসকে আরও বেদনাবিধুর করে তোলে। প্রশ্ন থেকে যায়,একজন সন্তান যদি দেখে তার বাবা রাস্তায় মার খাচ্ছে, কাপড়হীন, রক্তাক্ত, ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার করছে,তাহলে সেই সন্তানের মনে কী দাগ পড়ে? শিল্পী জীবনের চোখ দিয়ে দেখা সেই ব্যথা, আসলে সমাজের চোখেও এক সতর্কবার্তা।
এই লেখাটি তাই শুধুই একজন শিল্পীর পতনের কথা নয়, বরং একটি বৃহৎ সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি,যেখানে শিল্প, নৈতিকতা, জনপ্রিয়তা ও রাজনীতি এক জটিল মোড়কে বাঁধা পড়ে যায়।
এই স্ট্যাটাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিল্পীর পরিচয় যতটা গৌরবময়, তার পতনও ততটাই নির্মম হতে পারে,যদি সে নিজের শিকড় ভুলে যায়।
এই ঘটনা শুধু একজন অভিনেতার পতনের গল্প না, এটা যেন সময়ের এক নির্মম চাবুক, যেখানে জনপ্রিয়তা, ক্ষমতা আর রাজনীতির মোহ একসঙ্গে মিশে গিয়ে গড়ে তোলে এক নির্মম বাস্তবতা।
আর সেই বাস্তবতার মুখেই আজ প্রশ্ন,‘এই সিদ্দিক কোন সিদ্দিক?’
আপনার মতামত লিখুন :