রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী বাড়ছেই। অসুস্থ গরুর সংস্পর্শে আসা পুরুষদের পাশাপাশি সেই গরুর মাংস রান্নার কাজে সম্পৃক্ত নারীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি হিসাবে ৬ জনের অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ বলা হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি ১৫ জনেরও বেশি। এছাড়া আরও অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী রয়েছে বলে দাবি করছেন উপজেলার আমাইপুর গ্রামের বাসিন্দারা। মিঠাপুকুরে প্রথম অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী সনাক্ত হয় আমাইপুর গ্রামে। এরপর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যানথ্রাক্স মোকাবেলায় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, চিকিৎসা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীরা শরীরে ক্ষত নিয়ে দিনযাপন করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করলেও অনেকেই এই রোগের চিকিৎসা ও সচেতনতা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আক্রান্তদের অনেকেই স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রাণিসম্পদ দপ্তর গ্রামে কিছু গবাদিপশুকে টিকা দিয়েছে, তবে এখনও অনেক বাড়ির গবাদিপশু টিকা পাননি। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও অ্যানথ্রাক্স মোকাবেলায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এ কারণে এই রোগ প্রায় ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে উপজেলার আমাইপুর, দূর্গাপুর ও তরফসাদি গ্রামে অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী পাওয়া গেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ৬ জন অ্যানথ্রাক্স রোগী রয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি।
এর আগে উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে একটি অসুস্থ গরু জবাই করেন গ্রামের লোকজন। গরুটি তড়িঘড়ি করে জবাই করা হয় এবং কম মূল্যে মাংস বিক্রি করা হয়। এরপর ওই গরুটি প্রক্রিয়াজাত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এমনকি ওই গরুর মাংস রান্নার কাজে সম্পৃক্ত নারীরাও আক্রান্ত হয়েছেন।
আমাইপুর গ্রামের এক গৃহিণী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। তার বাম হাতের মধ্যম আঙুলে ক্ষত হয়েছে। আঙুল থেকে পুঁজ ও ময়লা পানি বের হচ্ছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে ওই গৃহিণী বলেন, ‘বাবা ওই গোছ (মাংস) বাড়ি আনি এই অবস্থা। খুব ব্যথা করে, পচে যাচ্ছে। কোন ডাক্তার আইসে নাই। আমরা গরীব মানুষ, এত টাকা কোথা থেকে পাই।’
একই গ্রামের দুই দিনমজুরেরও হাত, কোমর ও পিঠে অ্যানথ্রাক্সের ক্ষত দেখা গেছে। তারা স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ ও পাউডার ব্যবহার করছেন। এছাড়া গ্রামের আরও অনেকেই শরীরে চুলকানি ও ছোট-বড় ক্ষত নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকেই লোকলজ্জার কারণে প্রকাশ করছেন না। এমন একজন গৃহিণী, যার স্বামী বিদেশে, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হলেও নিজেকে আড়াল করে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সচেতন মহল বলছেন, দ্রুত অ্যানথ্রাক্স মোকাবেলায় জনসচেতনতার পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত না হলে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়বে।
ইমাদপুর ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘অ্যানথ্রাক্স মোকাবেলায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন ঈমাম, ইউপি সদস্য ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাতে কেউ অসুস্থ গরু জবাই করতে না পারে।’
মিঠাপুকুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলতাব হোসেন বলেন, ‘উপজেলায় বর্তমানে গরুর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ এবং দেড় লাখের বেশি ছাগল রয়েছে। সরকারিভাবে ৩৪ হাজার গবাদিপশুর জন্য টিকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তবে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।’
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. এম. এ. হালিম লাবলু জানিয়েছেন, ‘মিঠাপুকুরে ৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হলে ১ জনের পজিটিভ এসেছে। এছাড়া আরও কয়েকজন অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী রয়েছেন। আমরা সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, রংপুরের পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় এ পর্যন্ত ১১ জন অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী সনাক্ত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে পীরগাছা উপজেলায় ২ জন অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন