ছড়া কেবল শিশুভোলানো মনোরঞ্জনের উপাদান হিসেবে নয়, বরং শিশুর মনোজগৎ নির্মাণ, নৈতিকতাবোধের উন্মেষ এবং পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরির এক শৈল্পিক মাধ্যম হিসেবে ছড়া সমাদৃত। সমকালীন ছড়াকারদের মধ্যে আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক এক স্বতন্ত্র স্থানের অধিকারী, যার ছড়াগুলো আপাতসরল কাঠামোর অন্তরালে গভীর জীবনবোধ, শিক্ষামূলক বার্তা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার এক চমৎকার মেলবন্ধন ঘটায়।
শিশুরা তাদের চারপাশের জগৎটাকে দেখে এক সরল, কৌতূহলী ও বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে। সাদেকের ছড়ায় এই শিশুতোষ সারল্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটে উঠেছে। তার ‘শান্তা ও কান্তা’ ছড়াটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘ছোট্ট মেয়ে শান্তা বোনের নাম কান্তা বন্ধু দুই জনে। বিস্কুট চায় নোন্তা নরম ভাত পান্তা খায় দুই বোনে।’
এখানে শান্তা ও কান্তা নামের দুই বোনের দৈনন্দিন জীবনের এক খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাদের চাওয়া-পাওয়া অত্যন্ত সাধারণ নোন্তা বিস্কুট আর পান্তা ভাত। এই সাধারণ বর্ণনার মধ্য দিয়ে ছড়াকার শিশুর নির্মল জগতের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন, যেখানে জটিলতার কোনো স্থান নেই। ছড়াটির শেষাংশে ‘মারামারি করে না মিথ্যা কথা বলে না/ভালভাবে চলে’ এই পঙক্তিগুলো স্বাভাবিকভাবে শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক আচরণকে উৎসাহিত করে।
একইভাবে ‘এক দুই তিন’ ছড়াটিতে সংখ্যা গণনার মতো একটি শিক্ষণীয় বিষয়কে খেলার ছলে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘এক দুই তিন পড়ি সারা দিন। চার পাঁচ ছয় বড় মজা হয়।’
ছড়াটির দ্রুত লয় ও সহজ অন্ত্যমিল শিশুদের কাছে গণনাকে একটি আনন্দদায়ক কার্যক্রমে পরিণত করে। এখানে ‘বড় মজা হয়’ বা ‘নেই কোন ভয়’-এর মতো শব্দগুচ্ছ পড়াশোনার প্রতি শিশুর স্বাভাবিক ভীতি দূর করে একে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করার প্রয়াস লক্ষণীয়।
‘জন্মদিন’ ছড়াটিতে শিশুর চাওয়া-পাওয়ার একটি ফর্দ তুলে ধরা হয়েছে। চুড়ি, ঘড়ি, গয়না, শাড়ি থেকে শুরু করে লিপস্টিক, আয়না, গাড়ি—এই তালিকা শিশুর অপার কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু ছড়াকার নিছক বস্তুগত প্রাপ্তির বর্ণনায় থেমে থাকেননি। ছড়াটির শেষাংশ এক অসাধারণ মোড় নেয়: ‘বই চাই গল্পে ভরা দিতে হবে অনেক ছড়া ছবি আঁকার রংতুলি। পড়াশুনা করব সোনার বাংলা গড়ব হিংসা বিভেদ ভুলি।’
এখানে শিশুর ব্যক্তিগত আনন্দ ও আকাঙ্ক্ষার সাথে বৃহত্তর সামাজিক ও দেশাত্মবোধক চেতনাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। বস্তুকেন্দ্রিক জগৎ থেকে জ্ঞানার্জন এবং দেশ গড়ার মহান স্বপ্নে উত্তরণ—এই রূপান্তর ছড়াটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। ছড়াকার এখানে দেখিয়েছেন যে, শিশুর আনন্দ কেবল খেলনাকেন্দ্রিক নয়, সৃজনশীলতা ও দেশপ্রেমের বীজও তার মধ্যেই বপন করা সম্ভব।
সাদেকের ছড়ার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর শিক্ষামূলক ও নীতিকেন্দ্রিক আবেদন। তিনি প্রত্যক্ষ উপদেশের পরিবর্তে গল্পের ছলে, সহজ ভাষায় শিশুদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি প্রোথিত করার চেষ্টা করেন। ‘আকাশের মতো উদার হও’ ছড়াটি এই ধারার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
‘ছোট্টমণিরা সবাই মিলে হিংসা বিদ্বেষ সব ভুলে আকাশের মতো উদার হও। ... মানুষের প্রতি দয়া করো ভুল হলে ক্ষমা করো মারামারি করো না’
এখানে আকাশকে উদারতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে শিশুদের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে একে অপরের প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ক্ষুধার্তকে আহার দেওয়া বা দুঃখীর সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার মতো মানবিক গুণের কথাও তিনি বলেছেন। এই ছড়াটি শিশুর সামাজিকীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেখানে পারস্পরিক সহমর্মিতাই হয়ে ওঠে মূল ভিত্তি।
একইভাবে, ‘যাকিয়্যার বাসনা’ ছড়াটিতে যাকিয়্যা নামের এক ছোট্ট মেয়ের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের মাধ্যমে জনসেবার মহান আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে। ‘বড় হয়ে ইচ্ছে তার ডাক্তার হবে জীবনটা বিলিয়ে দেবে জনসেবায় রবে।’
এখানে পেশা নির্বাচনকে কেবল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে না দেখিয়ে, সেবাপরায়ণতা ও আত্মত্যাগের এক মহৎ ব্রত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাকিয়্যার ‘ভীষণ কষ্ট পায়’ অনুভূতিটি শিশুর কোমল হৃদয়ে অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলার এক শৈল্পিক প্রয়াস। শিশুসাহিত্য মানেই কেবল কল্পনার রঙিন জগৎ নয়, পারিপার্শ্বিক সমাজের বাস্তবতার সাথে শিশুর পরিচয় ঘটানোও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক এই দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তার ‘ঈদের জামা’ ছড়াটি বাংলা শিশুসাহিত্যে এক বলিষ্ঠ সংযোজন।
‘বাবার হাতে টাকা নেই জামা কেনার উপায় নেই তারা এতো দুখী। কারো আছে অনেক জামা কারো নেই একটিও জামা কেমন এই রীতি।’
ঈদের আনন্দের আবহের বিপরীতে একটি শিশুর জামা না পাওয়ার কষ্টকে তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সাথে তুলে ধরেছেন। ছড়াটি কেবল একটি শিশুর ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলে না, বরং সমাজের গভীরে প্রোথিত অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে সরাসরি আঙুল তোলে। ছড়াকার এখানেই থেমে না থেকে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরে এর সমাধানও বাতলে দেন:
‘ঈদে রোযার শিক্ষা নাও যাদের নেই তাদের দাও এই তো ঈদের নীতি।’
এই পঙক্তিগুলোর মাধ্যমে তিনি সহমর্মিতা, ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ এবং রোজার সংযমের শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার আহ্বান জানান। এটি শিশুদের কেবল আবেগপ্রবণ করে না, তাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন করে তোলে।
শিশুর মনে কেবল আবেগ বা নৈতিকতা নয়, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার বীজ বপন করাও আধুনিক শিশুসাহিত্যের একটি লক্ষ্য। সাদেকের ‘পৃথিবীর চারি কোণ’ ছড়াটি এই কাজটি অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে করেছে। ‘বাবা বলেন শিশুকে তার এমন গুণের হও ভুবনে যেনো তব নাম ছড়ায় এই পৃথিবীর চারি কোণে শিশু বলে ওগো বাবা তোমার কথাই তো ভুল পৃথিবীর তো কোণই নাই এই পৃথিবী যে গোল।’
এই ছড়াটিতে প্রচলিত বাগধারার আক্ষরিক অর্থকে চ্যালেঞ্জ করে একটি শিশু তার বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান উপস্থাপন করছে। এখানে বাবা ও শিশুর কথোপকথনের মাধ্যমে প্রজন্মের ব্যবধান এবং জ্ঞানের রূপান্তরকে তুলে ধরা হয়েছে। শিশুটি তার বাবাকে শ্রদ্ধা রেখেই তার ধারণাগত ভুল ধরিয়ে দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, জ্ঞান কেবল বয়স বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল নয়, সঠিক শিক্ষা ও তথ্যের মাধ্যমে একটি শিশুও যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। ‘ভাঙ্গা ডিম’ ছড়াটি ধাঁধার আঙ্গিকে রচিত, যা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করে।
‘ভাঙ্গার পরেই কাজে লাগে না ভেঙ্গে কাজ হয় না’
এই ধরনের ধাঁধা শিশুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে শানিত করে। এটি নিছক মনোরঞ্জন নয়, বরং এক ধরনের মস্তিষ্কের ব্যায়াম।
কিছু ছড়ায় সাদেক শিশুতোষ সারল্যের সীমানা পেরিয়ে এক গভীর জীবনদর্শন ও অনুপ্রেরণার বার্তা দিয়েছেন, যা কেবল শিশু নয়, বয়স্কদেরও ভাবতে শেখায়। ‘কে কী চায়’ ছড়াটি এর একটি চমৎকার উদাহরণ।
‘আকাশ চায় বৃষ্টি হয়ে ঝরতে বৃষ্টি চায় ফুল বাগানে পড়তে ... ভালবাসা চায় একতা গড়তে একতা চায় শান্তি সৃষ্টি করতে।’
এখানে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের আকাঙ্ক্ষার একটি শৃঙ্খল তৈরি করা হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত মানব সমাজের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু-শান্তিতে গিয়ে সমাপ্ত হয়। আকাশ, বৃষ্টি, ফুল, ভালোবাসা, একতা থেকে শান্তি পর্যন্ত এই যাত্রা এক গভীর বাস্তুতান্ত্রিক এবং সামাজিক আন্তঃসম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
‘এগিয়ে চলো’ ছড়াটি আরও সরাসরি অনুপ্রেরণামূলক।
‘এগিয়ে যদি যেতে চাও টানিবে ওরা পিছু উপরে যদি উড়িতে চাও টানিবে ওরা নিচু। ... শত বাঁধা থাকলেও নাই ভীতি এগিয়ে যাও, সামনে যাওয়াই নীতি।’
এটি জীবনসংগ্রামের এক শ্বাশত চিত্র। জীবনে চলার পথে যে বাধা-বিপত্তি বা ঈর্ষার সম্মুখীন হতে হয়, সে সম্পর্কে শিশুকে সচেতন করে দিয়ে তাকে নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়েছে। এই ছড়াটি শিশুর আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়সংকল্প তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেকের ছড়ার শিল্পসৌকর্য তার সহজবোধ্য ভাষা, গতিময় ছন্দ এবং যথাযথ শব্দচয়নের মধ্যে নিহিত।
তার অধিকাংশ ছড়া স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত, যা বাংলা ছড়ার প্রাণ। এই ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর শ্বাসাঘাতপ্রধান, দ্রুত ও প্রবহমান গতি, যা শিশুদের আবৃত্তি ও শ্রবণের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ‘এক দুই তিন/পড়ি সারা দিন-এর মতো পঙক্তিতে ছন্দের দোলা শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করে। ছন্দের এই সুনিপুণ ব্যবহার তার ছড়াগুলোকে স্মরণীয় করে তুলেছে। সাদেকের ছড়ায় অন্ত্যমিলের ব্যবহার অত্যন্ত সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। ‘চায়-পায়’, ‘হবে-রবে’, ‘শান্তা-কান্তা’, ‘তিন-দিন’, ‘ছয়-হয়’- ইত্যাদি নিখুঁত অন্ত্যমিল ছড়াগুলোকে শ্রুতিমধুর ও মজবুত গঠন দান করেছে। এই মিলগুলো ছড়ার পঙক্তিগুলোকে সহজে মনে রাখতে সাহায্য করে।
আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক এর ছড়াগুলো কেবল নির্দোষ আনন্দের উৎস নয়, বরং শিশুর মনোজগৎ গঠনের এক শক্তিশালী উপকরণ। তিনি ছড়ার মাধ্যমে আনন্দ ও শিক্ষাকে একীভূত করেছেন। তার লেখায় একদিকে যেমন শিশুর কল্পনা ও কৌতূহলকে উসকে দেওয়ার প্রয়াস রয়েছে, তেমনই রয়েছে তাকে একজন নৈতিক, যুক্তিবাদী ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা। তার ছড়াগুলো প্রমাণ করে যে, শিশুসাহিত্য নিছক ছেলেভোলানো রূপকথা নয়, বরং এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করার এক শৈল্পিক মাধ্যম।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন