উলের চাদর তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার তাঁতীরা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতপল্লী খট্ খট্ শব্দে মুখরিত।
উপজেলার নওদাপাড়া, দেবখন্ড, সানাপাড়া, জিয়ানগরের ভেঁপড়া, বারাহী, বাঁকপালসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের অন্তত চারশ পরিবার শীতের সময় চাদর ও অন্য সময় গামছা তৈরি করেন। শীত মৌসুমের শুরুতে নারী-পুরুষদের চাদর তৈরিতে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
প্রতিটি বাড়িতে খট্ খট্ শব্দে তাঁত চলছে। এখানে তৈরি চাদরের অধিকাংশই আদমদীঘি থানাধীন শাওইল হাট ও দুপচাঁচিয়া সদরের ধাপসুলতানগঞ্জ হাট, তালোড়া হাট, সাহারপুকুর হাট, চৌমুহনী হাট, তালুচহাট, জিয়ানগর হাট ও অনেকে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে তাদের তৈরি করা চাদর বিক্রি করেন।
দেবখন্ড গ্রামের রতন, মহিউদ্দিন, আব্দুর রহমান, নওদাপাড়া গ্রামের নবাব আলী, আব্দুল মান্নান জানান, চাদর তৈরির প্রধান উপকরণ উলের সুতা। সেই সুতা আদমদীঘি থানার শাওইল হাট থেকে সংগ্রহ করা হয়। ওই হাটেই তাদের তৈরি অধিকাংশ চাদর বিক্রি করেন। এ ব্যবসা শুরু আর্শ্বিন থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি। বাজারে অন্যান্য চাদরের তুলনায় তাদের তৈরি করা চাদরের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এর চাহিদা থাকে বেশি। ফলে এ কয়েক মাস তাঁতপল্লীর বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ চাদর তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। সংসারের কাজের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এ ব্যবসা করে আর্থিকভাবে লাভবানও হন তারা।
তাঁতীরা জানান, এক কেজি উলের সুতার দাম ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। এক কেজি সুতায় তিনটি চাদর হয়। তিনটি চাদরের পাইকারি মূল্য প্রকারভেদে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। একজন দিনে ৫ থেকে ৭টি চাদর তৈরি করতে পারেন।
নওদাপাড়া গ্রামের জহরুল ইসলাম জানান, এক সময় তার বাড়ি ছিল না। উলের চাদরের ব্যবসা করে ইটের বাড়ি ও মুরগির খামার করছেন।
একই গ্রামের অপর ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম জানান, চাদর তৈরি ও বিক্রি করে তার সংসারের অভাব দূর হয়েছে। তিন মেয়ে এক ছেলে স্কুলে লেখাপড়া করে। তিন বিঘা জমি পত্তন নিয়ে চাষাবাদ করছেন।
কারিগররা আরও জানান, নিজস্ব পুঁজির অভাবে অনেকেই ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে উলের সুতা কিনে চাদর তৈরি করেন। যে কারণে ঋণ পরিশোধ করে হাতে তেমন কিছু থাকে না।
এছাড়াও গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ফুটানিগঞ্জ গ্রামের তাঁতপল্লীর কারিগররা (নারী-পুরুষ) উলের চাঁদর তৈরিতে ব্যস্ততা দেখা যায়। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতপল্লীতে চাদর বুনানোর মেশিনের খটখটির শব্দে এলাকা এখন মুখরিত।
সরেজমিনে দুপচাঁচিয়া উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের ফুটানিগঞ্জ গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এই গ্রামে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ পরিবারের সদস্যর মধ্যে ৯০ শতাংশ পরিবারই তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিল্পকে বাঁচাতে তারা নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছে। ওই গ্রামের তাঁতশিল্পের কারিগর লুৎফর রহমান, এমদাদুল, মিনাজ, সোহরাব হোসেন, ফেরদৌস, আকলিমা বেগম, আফরোজাসহ অনেকেই বলেন, আজকাল অনেকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় কেউ কেউ পাওয়ার লুম মেশিন কিনেছেন। সনাতনী পদ্ধতির আমলের হাতে চালিত পুরোনো হ্যান্ডলুম মেশিন ব্যবহার করে দিনে ৮ থেকে ১০টি চাঁদরসহ অল্প সংখ্যা গামছা, লুঙ্গি, কম্বল তৈরি করা যেত। এখন আধুনিকতা ছোঁয়ায় পাওয়ার লুম মেশিন কিনতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে উচ্চ সুদের ঋণ নিয়ে তাদের তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের দাবি সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ ও আর্থিক সহযোগিতায় শহর স্বল্প সুদে অর্থ পেলে তাঁতশিল্পের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরে রাখা সম্ভব।

